নতুন শিক্ষাক্রম: শিক্ষকদেরই ধারণা কম শিক্ষার্থীদের হিমশিম

ঢাকাঃ  নতুন শিক্ষাক্রমের ১১ মাস হতে চললেও এখনো তা পুরোপুরি আয়ত্ত করতে পারেননি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। মধ্যরাত পর্যন্ত হোমওয়ার্ক, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রজেক্টের কাজে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষকরাও নতুন শিক্ষাক্রমের অনেক কিছুই ঠিকমতো বুঝতে পারেন না। পড়াতে গিয়ে তাদের ব্যাপক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এ কারণে অনেক সময় কোনো গাইডলাইন না দিয়েই তারা হোমওয়ার্ক দেন। এতে শিক্ষার্থীরা পড়ে বিপাকে। ঠিক কী করতে হবে বা কী চাওয়া হয়েছে, কোথা থেকে কোন তথ্য কতটুকু নিতে হবে, সে সম্পর্কে তাদের স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয় না। এতে তারা নিজেদের মতো করে গুগল, ইউটিউব এমনকি ফেসবুক থেকে তথ্য নিয়ে হোমওয়ার্ক শেষ করে। এতে কাজের মূল উদ্দেশ্য পূরণ ও গুণগত মানও নিশ্চিত হচ্ছে না। আবার অনেক অভিভাবক শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিভাইস নির্ভরতা বৃদ্ধির আশঙ্কাও করছেন। অন্যদিকে নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে অভিভাবকদের জানাশোনা কম থাকায় তারা বাচ্চাদের প্রাইভেট বা কোচিংয়ে পড়াতে বাধ্য হচ্ছেন।

রাজধানীর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিন ইয়াসার। নতুন শিক্ষাক্রমে ক্লাস কেমন লাগছে—জানতে চাইলে সে জানায়, চাপ অনেক বেড়েছে। হোমওয়ার্ক, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রজেক্ট ইত্যাদি শেষ করতে প্রায়ই গভীর রাত হয়ে যায়। পুরো বইয়ের ছক পূরণেও খুব কম সময়ই দেওয়া হয়। ক্লাসে দলগত কাজে শিক্ষকরা অনেক সহযোগিতা করেন। তবে অনেক সময় কোনো গাইডলাইন না দিয়েই হোমওয়ার্ক দেন। তাই গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব থেকে তথ্য খুঁজে বের করি। এ কারণে সময় অনেক বেশি লাগে। তারপরও সব সময় সব তথ্য ঠিকমতো পাই না। নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ার পর গত ১০ মাসে অন্তত ৫০টি অ্যাসাইনমেন্ট ও ১৫-২০টি প্রজেক্ট করতে হয়েছে সামিনের।

সামিনের বাবা আমিরুল ইসলাম বলেন, আমরা আগের শিক্ষাক্রমে পড়াশোনা করেছি। নতুন শিক্ষাক্রমের অনেক বিষয়ই আমাদের অজানা। সে কারণে অনেক সময়ই বাচ্চার প্রশ্নের জবাব দিতে পারি না। এতে বাচ্চাদের বাড়তি চাপ নিতে হচ্ছে। তারা অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রজেক্ট শেষ করতে রাত পার করে দিচ্ছে। শুনেছিলাম এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের পাশাপাশি অভিভাবকদের সংযুক্ত করা হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত স্কুল বা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও অভিভাবকদের সংযুক্ত করার কোনো উদ্যোগ দেখিনি। শহরের অভিভাবকরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাচ্চাদের সহযোগিতা করতে পারলেও গ্রামের চিত্র ভয়াবহ। শুধু সামিন নয়, নতুন শিক্ষাক্রমে চাপ অনুভব করার কথা জানিয়েছে রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্কুলের শিক্ষার্থীরা। একই কথা জানান অভিভাবকরাও।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস ঐশী জানায়, তাকে বইয়ের ছক পূরণ করতে হয়, পোস্টার বানাতে হয়, ছকের মধ্যে থাকা প্রশ্নের উত্তর খাতায় লিখে দিতে হয়। এর বাইরে অনেক অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রজেক্ট থাকে। কিছু সে নিজে বানায়, আর কিছু দলগতভাবে বানাতে হয়। গত ১০ মাসে তাকে অন্তত ৪০টি অ্যাসাইনমেন্ট ও ২০টি প্রজেক্ট করতে হয়েছে। এসব করার সময় শিক্ষক ও বাবা-মায়ের সহযোগিতা সেভাবে পায়নি। শিক্ষকরা শুধু হোমওয়ার্ক দেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সে সম্পর্কে আগ থেকে কোনো ধারণা দেন না। এসব শেষ করতে রাত ১টা-২টা বাজে। কাজ শেষ করে ঘুমাই। সকালে উঠে ক্লাসে ছুটতে হয়।

ঐশীর মা তাহেরা আক্তার বলেন, মেয়ে সকালে স্কুলে যায়, বিকেলে ফিরে। বাসায় ফেরার পর থেকে স্কুলের হোমওয়ার্ক ও অ্যাসাইনমেন্ট করতে করতে মধ্যরাত হয়ে যায়। এভাবেই ওর দিন যাচ্ছে। ইদানীং ওর মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। বেশি রাতে ঘুমিয়ে খুব সকালে ওঠার কারণে হয়তো এমনটা হচ্ছে। হোমওয়ার্ক, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রজেক্ট করতে ঐশীকে গুগল, ফেসবুক, ইউটিউবের ওপর বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে। এ কারণে তার মধ্যে ডিভাইস আসক্তি দেখা দিয়েছে। স্কুল থেকে কয়েকবার অভিভাবক সমাবেশ করে নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ে কিছু ধারণা দেওয়া হলেও তা যথেষ্ট নয়।

রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভিভাবকদের সঙ্গে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে কথা হলে তারাও জানিয়েছেন, নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে তাদের ধারণা অল্পবিস্তর। শিশুরা সকালে স্কুলে যায়, বিকেল বা সন্ধ্যায় বাসায় ফেরে। এরপর খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে হোমওয়ার্ক ও অ্যাসাইনমেন্ট শুরু করে। মাঝেমধ্যে করে প্রজেক্টের কাজ। এগুলো শেষ করতে করতে রাত প্রায় ১২টা বেজে যায়। অনেক সময় তাদের পিঠে ব্যথা করে। কিন্তু শিক্ষকের শাস্তির ভয়ে কাজ শেষ করার আগে ঘুমায় না। শিক্ষকরা ক্লাসে পাঠদানের সময় ঠিকমতো না বুঝিয়ে হোমওয়ার্ক দেয়, আবার অভিভাবকদেরও শিক্ষাক্রম সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ধারণা দেওয়া হয়নি। নিজেরা না বুঝতে পারায় অনেক অভিভাবক এখনো বাচ্চাদের প্রাইভেট বা কোচিংয়ে পড়াচ্ছেন।

ফেনীর সোনাগাজীর আল হেলাল একাডেমির ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীর অভিভাবক শারমিন আক্তার বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের অনেক কিছুই বুঝতে পারি না। বাধ্য হয়ে মেয়েকে কোচিংয়ে দিয়েছি। ষান্মাষিক মূল্যায়নে আমার মেয়ে ত্রিভুজ পেয়েছে। কীসের ভিত্তিতে এটা দেওয়া হয়েছে—জানতে চাইলে শিক্ষকরা স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারছেন না। তাদেরও মনে হয় শিক্ষাক্রম জানার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়ে গেছে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানী ও বাইরের বিভিন্ন স্কুলের অন্তত ১০ জন শিক্ষক জানান, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে তারা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পাননি। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে প্রকল্পে কর্মরত অনভিজ্ঞ একাডেমিক সুপারভাইজারদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে। যে কারণে তারা অনেক কিছুই ঠিকমতো বুঝতে পারেন না। ফলে পড়াতে গিয়ে শিক্ষকদের ব্যাপক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। বইয়ের কোনো অংশ না বুঝলে ইউটিউব বা ফেসবুকের বিভিন্ন ভিডিও বা পোস্ট থেকে তথ্য নিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াতে হয়। আবার কোনো কোনো অংশের বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্যও পাওয়া যায় না। সে কারণে ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষার্থীদের না বুঝিয়েই হোমওয়ার্ক বা অ্যাসাইনমেন্ট দিতে হয়।

তারা আরও বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সমালোচনা করায় নবম-দশম শ্রেণির রসায়ন বইয়ের লেখক, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার বিদ্যুৎ কুমার রায়কে শোকজ করা হয়েছে। সে কারণে তাদের কাছে এই শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন দিক কঠিন মনে হলেও তারা চুপ করে আছেন। এমনকি প্রশিক্ষণ, উপকরণ, মূল্যায়ন নিয়ে পরামর্শ দেওয়ার থাকলেও তারা চুপ থাকেন।

চট্টগ্রামের সিলভার বেলস কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড গার্লস হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর অভিভাবক দিলরুবা সুলতানা বলেন, বছরের শুরুতে নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে পরিচয় করিয়ে দিতে এবং সম্প্রতি মূল্যায়নের বিষয়ে ধারণা দিতে অভিভাবক সমাবেশ করা হয়। তবে সেটি যথেষ্ট নয়। আবার স্কুল থেকেও বাচ্চাকে অনেক সময় সবকিছু বুঝিয়ে দেওয়া হয় না। ফলে বাচ্চারা ডিভাইসমুখী হচ্ছে। ইউটিউব, গুগল থেকে বিভিন্ন তথ্য হুবহু কপি করছে।

নতুন শিক্ষাক্রমের কার্যক্রমে অভিভাবকদের আরও বেশি সংযুক্ত করা উচিত বলে মনে করেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানরাও। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী বলেন, অভিভাবকদের যে নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে বিস্তারিত জানানো দরকার, তা আমরা উপলব্ধি করেছি। মাউশিও এ বিষয়ে তৎপর। নতুন কিছু এলে সেটা স্থায়ী হতে কিছুটা সময় লাগে। নতুন শিক্ষাক্রমের শুরুটাও তেমনি ধাক্কা খেয়েছে। আশা করি, আগামী বছর থেকে আর এসব সমস্যা থাকবে না।

উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আ ন ম শামসুল আলম খান বলেন, প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্যোগ নিয়ে আমরা ছয়বার অভিভাবকদের সঙ্গে বসেছি। তাদের শ্রেণিকক্ষেও নিয়ে গেছি। আলাদা আলাদা সেকশনের অভিভাবকদের সঙ্গেও আমাদের বসা হয়েছে। মূলত এই শিক্ষাক্রমে অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করতেই হবে। নয়তো পুরো বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

তবে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ বাড়ার বিষয়টি মানতে নারাজ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান। তিনি বলেন, অ্যাসাইনমেন্ট ছাত্রছাত্রীকেই করতে হবে। এসব শিক্ষক-অভিভাবক করে দেবেন না। আমরা তো জানি, তার কাজ কোনো বিশেষজ্ঞের মতো হবে না। সে কাজটা করার প্রক্রিয়া জানে কি না, তাকে যেভাবে বলা হচ্ছে সে সেভাবে করতে পারছে কি না, আমরা সেটাই জানতে চাই! একজন শিক্ষক যদি ভালো নির্দেশনা না দিতে পারেন, যেভাবে দিয়েছে সেভাবেই করুক। কোনো শিক্ষার্থীর অ্যাসাইনমেন্ট করার সময় কোনো তথ্য জানার প্রয়োজন হলে সে অভিভাবকের সাহায্য নেবে। অভিভাবক নিজে জানলে উনি জানাবে, না জানলে কমিউনিটির মধ্যে কেউ জানলে তার কাছ থেকে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করবে। তথ্য সংগ্রহ করতে হবে বিভিন্ন সোর্স থেকে। সব শিক্ষাক্রমেই অভিভাবক সম্মেলন ছিল। তবে এখন একটু বেশি করতে বলা হচ্ছে।

এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিচালক (বিদ্যালয়) বেলাল হোসাইন বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে আমরা স্কুলগুলোতে লিফলেট বিতরণের ব্যবস্থা করেছি। টিচার্স গাইডে শিক্ষকদের করণীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে। এরপরও তাদের করণীয় বিষয়ে মাউশি থেকে নির্দেশনা দিচ্ছি। অভিভাবকদের নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে বুঝাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেওয়া আছে। চলতি বছর সংস্কারযোগ্য করে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। এ বছর যেসব সমস্যা সামনে এসেছে আগামী বছর সেসব থাকবে না।

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৭/১১/২০২৩ 

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়