দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধিতে চিড়েচ্যাপ্টা জনগণ

।। প্রশান্ত কুমার বর্মণ ।।

বর্তমানে বাংলাদেশের নিত্যপণ্যের বাজারের বেহাল দশা। চক্রবৃদ্ধির গতিতে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রব্যের দাম আর এই দাম যেন কোনো ক্রমেই থামছে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি যেন আমাদের নিকট নতুন কোনো সংবাদ নয়। গত তিন বছরে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন দাম ব্যবস্থার কারণে জনসাধারণ অতিষ্ঠ। প্রতিটা পণ্যই যেন দাম বাড়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে আর এগুলোর জন্য দায়ী কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। অন্যান্য দেশে যেখানে দ্রব্যমূল্যের দাম কমানোর প্রতিযোগিতা হয় আমাদের দেশ সেখানে পুরোপুরি ব্যতিক্রম। দ্রব্যমূল্যের এই বৃদ্ধি আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

সম্প্রতি সিলেটের চা শ্রমিকদের কথা বিবেচনা করা যাক- যাদের দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি সেই মজুরি দিয়ে কিনা তাদের ২৫০ গ্রাম তেল, ২৫০ গ্রাম ডাল এবং ১ কেজি চাল কিনতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তাদের বেতন ৫০ টাকা বাড়িয়ে বর্তমানে ১৭০ টাকা করা হয়েছে। অনেক মানুষই আছে- দ্রব্যের দাম বেশি হওয়ায় যাদের দৈনিক মজুরির টাকায় পরিবারের ভরণপোষণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং এর ফলশ্রুতিতে তারা অনাহারেও দিনাতিপাত করে।

সিলিন্ডার, তেলের দাম, গ্যাসবিল, বিদ্যুৎ বিলসহ বিভিন্ন জ্বালানি দ্রব্যের দাম ক্রমাগত বাড়ছেই এবং এগুলো সাধারণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষজন অনেক বিপাকে। বর্তমানে মাংসের কথা না বললেই নয়- প্রাণিজ আমিষের মধ্যে সহজলভ্য ছিল ব্রয়লার মুরগি ও মুরগির ডিম কিন্তু এর বর্তমান বাজার দাম মানুষের মাঝে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ব্রয়লার মুরগির দাম ১৩০-১৪০ টাকা কেজি থেকে এক লাফে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ২০০-২২০ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

সাধারণের নাগালের বাইরে গরু ও খাসির মাংসের দামও। গরু ও খাসির মাংসের বিকল্প হিসেবে ব্রয়লার মুরগিই ছিল গরিব ও শ্রমজীবী মানুষদের একমাত্র সম্বল কিন্তু লাগামহীন বাজার ব্যবস্থা তাদের আমিষের চাহিদা মেটানোর একমাত্র অবলম্বন ব্রয়লার মুরগির বাজারও এখন বেশ অস্থিতিশীল। গরুর মাংসের বর্তমান দাম কেজিতে ৭০০-৮০০ টাকা ও খাসির মাংসের দাম কেজিতে ৯৫০-১০০০ টাকা যা সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে এবং তা কিনতে মধ্যবিত্ত মানুষেরাও পর্যন্ত হিমশিম খাচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের একজন সাধারণ মানুষ যেখানে প্রতি বছরে গড়ে মাংস খায় ২১ কেজি সেখানে বাংলাদেশের মানুষ খায় গড়ে ৪ কেজি মাত্র।

প্রতিনিয়তই যেন দ্রব্যমূল্যের দাম দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণ হচ্ছে। নিয়মিত দাম বৃদ্ধিতে যেকোনো ক্রেতার চক্ষু যেন চড়কগাছ। ময়দা, চাল, ডাল, তেল, কাঁচাসবজি ছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যের দামের বৃদ্ধি খেটে খাওয়া মানুষদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করছে যেখানে তিনবেলা খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাটাই খুব কষ্টসাধ্য। যত তাড়াতাড়ি কোনো একটা দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পায়, ঠিক তত দ্রুত সেই দাম নিম্নমুখী হয় না।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বাজারব্যবস্থা এখন অনেক বেশিই ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে এবং দাম বাড়ায় অনেকে আবার তাদের পছন্দের খাবার নেওয়ায় ইতস্ততবোধ করে কিংবা নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী দ্রব্য কেনা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বেশি লাভের আশায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী খাদ্যদ্রব্যের সাথে ভেজাল ও বিভিন্ন ক্ষতিকর রং মেশাচ্ছে যা আমাদের দৃষ্টির বাইরে ও অগোচরে এবং যা আমাদের শরীরের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন রকমারি পণ্যের দাম যেমন: খাদ্যদ্রব্য, পোশাক, ফার্নিচার, কসমেটিকস, আসবাবপত্র ও ইলেকট্রনিকস জিনিস ইত্যাদির দাম নিয়মিত হারে বাড়াচ্ছে যা ক্রেতাদের মধ্যে এক বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করছে। চাহিদার তুলনায় দ্রব্য কম থাকায় দাম বাড়ছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। দ্রব্যমূল্যের এই বৃদ্ধিতে দেশের অর্থনীতিবিদগণও অনেক শঙ্কিত।

দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত মানুষদের জন্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এক অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ ১৮ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৫.৬ শতাংশ হওয়ায় এখনও তারা তাদের মৌলিক অধিকার- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এসব ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। প্রধানমন্ত্রীর সুষ্ঠু পরিকল্পনার দ্বারা দারিদ্র্যের হার এখন অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। তবে বাজার ব্যবস্থা এখনো হ য ব র ল। একজন ব্যক্তির জীবিকা নির্ভর করতে হলে অবশ্যই প্রয়োজন সুষম এবং ভেজালমুক্ত খাদ্য কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটার চিত্র যেন পুরোপুরি বিপরীত। এর যথোপযুক্ত কারণটা হলো কিছু ব্যবসায়ীদের কূটবুদ্ধি ও নীতিবিরুদ্ধ কাজ। তারাই দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ায় এবং বাজার থেকে কম দামে দ্রব্য কিনে নিয়ে পরবর্তীতে আবার সেগুলো অধিক লাভের আশায় বেশি দামে বাজারে বিক্রি তাদের সুযোগের সদ্ব্যবহার করে।

এসব দাম বৃদ্ধির পিছনে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর সাথে অন্য সিন্ডিকেটের অবৈধ হাত থাকাতে দীর্ঘসূত্রতা হিসেবে ভোগান্তি হচ্ছে আমাদের মতো নিরীহ মানুষদের। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান আমাদের মৌলিক অধিকার হওয়ায় এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের এবং ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দের। নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে ভোক্তা অধিদপ্তর, ভ্রাম্যমাণ আদালত ও প্রশাসনের নিয়মিত বাজার মনিটরিং জরুরি এবং এই ব্যবসায়ীদের জরিমানা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় এনে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করা হোক।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৪/১১/২০২৩ 

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়