ত্রিমুখী শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় সাধন প্রয়োজন!

আজগারুল ইসলামঃ সহজ কথায় শিক্ষা হলো- মানুষের কাক্সিক্ষত আচরণিক পরিবর্তন। স্বামী বিবেকানন্দের মতে, ‘শিক্ষা হলো জ্ঞান, যা প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে আছে। শিক্ষার কাজ এ জ্ঞানকে আবিষ্কার করা ও বহিঃপ্রকাশ ঘটানো।’ সুতরাং শিক্ষার উদ্দেশ্যই হলো মানুষের ভেতরের সত্তাটিকে প্রস্ফুটিত করা।

আইনস্টাইন শিক্ষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন,  ‘কল্পনাশক্তি জ্ঞান থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ এখানে তিনি বলতে চেয়েছেন মানুষের কাজ শুধু বিদ্যা আয়ত্তাধীন করা নয়; বরং সেটিকে উপলব্ধি করতে শেখা।

জন ডুয়ি এ সম্পর্কে বলেন, ‘শিক্ষা হলো দর্শনের পরীক্ষাগার যেখানে দার্শনিক সত্যতার যথার্থতা পরীক্ষিত হয়।’

অর্থাৎ শিক্ষার জন্য প্রয়োজন যাবতীয় বিষয়ের দার্শনিক পর্যালোচনা ও অন্তর্ভেদী দৃষ্টিকোণ। সুতরাং একজন শিক্ষিত মানুষকে অবশ্যই দার্শনিক হতে হবে। তা ব্যতীত জ্ঞানার্জনে সে পূর্ণতা অর্জন করতে পারবে না। কিন্তু আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় এই দার্শনিক চিন্তাভাবনার অবকাশ কতটুকু? রবীন্দ্রনাথ তখন বলেছিলেন, ‘আমাদের বঙ্গদেশে এমন সৃষ্টিছাড়া শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে যেখানে ছাত্ররা বিভিন্ন সাল, ঘটনা, হাজার হাজার বিদ্যা গিলতে পারে কিন্তু স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে না।’ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমাদের সমস্ত পাঠ্যবই হলো অপাঠ্য।’ আমাদের শিক্ষকদের উচিত বিদ্যা অর্জনের জন্য দার্শনিক মনোভাব গড়ে তোলা কিন্তু তারা বিদ্যার পুনরাবৃত্তি করে তাদের জ্ঞানকে জাহির করে থাকেন। যা দিয়ে আদৌ শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য অর্জিত হয় না। আমরা আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বাদ দিয়ে ইউরোপ- আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার উন্নতিকরণার্থে নানা উপকরণ, সিলেবাস ধার করে আনি। এর মাধ্যমে যেন আমরা এটিই জানান দিতে চাই যে, আমরা ইংরেজিতে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য উপযুক্ত। যে কথা রবীন্দ্রনাথ বলে গিয়েছিলেন। জ্ঞানের সাথে আমাদের মনের সম্পর্ক কমে গিয়ে এটি যান্ত্রিক শিক্ষায় পরিণত হচ্ছে। জ্ঞানের মূল শাখা থেকে বেরিয়ে এসে আমরা ততটুকুই পড়ছি যতটুকু আমাদের চাকরির প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন নিছক আমলা তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। আমাদেরকে এই আমলা তৈরির কারখানাসদৃশ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে আসল জ্ঞানচর্চায় ব্রতী হতে হবে।

এবার আমাদের শিক্ষাপদ্ধতির কিছু অসঙ্গতির কথা বলা যাক। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় সমস্যা হলো শিক্ষার ত্রিমুখিতা। সাধারণ শিক্ষা, আলিয়া শিক্ষা ও কওমি শিক্ষা। কিন্তু এই ব্যবস্থার ফলে আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষার সাথে কিছুটা তাল মিলিয়ে উঠতে পারলেও সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকসহ রাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অঙ্গনে কওমি শিক্ষার্থীরা পশ্চাৎপদ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি তারা নিজেরাও একটি সমন্বিত সিলেবাসের সাথে চলতে রাজি নন। তারা ঘরোয়াভাবে নিজেদের তৈরি করা সিলেবাস অনুসরণ করেন। যাতে করে এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়ে যাচ্ছে।

আমাদের প্রয়োজন সবার জন্য এমন একটি সিলেবাস প্রণয়ন করা, যাতে করে সবাই সমান জ্ঞান নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে পারে। এর জন্য সবাইকে একটি প্ল্যাটফর্মে আসতে হবে। চিন্তাভাবনার জায়গাটিকে প্রশস্ত করতে হবে, গোঁড়ামি বাদ দিয়ে উদার হতে হবে। আমাদের কোনো কোনো ওলামায়ে কেরামের ধারণা, আমরা শুধু কুরআন-হাদিস বিষয়ে অধ্যয়ন করব। গণিত, বিজ্ঞান, সমাজ, ইতিহাস, রাষ্ট্র নিয়ে এত বিস্তর পড়াশোনা করে কী হবে? কিন্তু প্রথমেই আমাদের মনে রাখতে হবে, ইসলাম হলো একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার নাম। এখন এই পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার অর্থ কী? জীবনে চলতে গেলে সামগ্রিকভাবে আপনার যা কিছু প্রয়োজন বা যা কিছুর মুখোমুখি হতে হবে সেসবের সামগ্রিক রূপই হলো ইসলাম। আর কুরআন হলো বিজ্ঞানময়। কুরআন বুঝতে হলেই আপনাকে বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি শিখতে হবে। কোনো নবী বা রাসূলের কাজ শুধু ধর্মপ্রচার ছিল না। সমাজের বিস্তীর্ণ অঙ্গনে তারা পদচারণা করেছেন। এই মুসলিমরাই প্রথমে গণিতশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্রের গোড়াপত্তন করেছিল। ইবনে সিনা, ইবনে খালদুন, আল-খাওয়ারিজমি, আল-মাসুদি, ইবনে রুশদ প্রমুখ ব্যক্তি যেমন ধর্মপ্রাণ মুসলিম ছিলেন একই সাথে বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন। কিন্তু আমরা সেখান থেকে সরে এসে একটি গোঁড়ামিপূর্ণ চিন্তাধারাকে বেছে নিয়েছি। আমাদের কিছু কিছু ওলামায়ে কেরামের বদ্ধমূল ধারণা, আমাদের শিক্ষার প্রধান কাজ বিভিন্ন মাসয়ালা-মাসায়েল জানা, সালাত, সিয়াম, হজ, জাকাতের নিয়মাবলি রপ্ত করা। কিন্তু এই সঙ্কীর্ণ ধারণার দরুন তারা ব্যাপকভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বেশির ভাগ মাদরাসাছাত্র বেকার বা ছদ্ম বেকার। তারা আধুনিক প্রযুক্তির সাথে পরিচিত নয়। যদিও ইদানীং মাদরাসার ছেলেরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভালো করছে। কিন্তু সে সংখ্যা সীমিত। বেশির ভাগই অকৃতকার্য হচ্ছে। বর্তমানে আলিয়া মাদরাসাগুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২২ লাখ ও কওমি মাদরাসাগুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪ লাখ। এরা সবাই মেধাবী। কিন্তু এই ছাত্ররা বিশেষ করে কওমি মাদরাসার ছেলেগুলো পাস করে বের হওয়ার পর তাদের জন্য বরাদ্দ থাকে মসজিদের ইমামতি, কওমি মাদরাসায় শিক্ষকতার মতো পেশা। কোনো পেশাকেই আমি খাটো করছি না। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে তাদের জীবনধারণ কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।

মুসলমান কোনো সুরতের নাম নয়। একটি জাতির সন্তানরা যত বেশি জ্ঞানার্জন করতে পারবে, সে জাতি তত বেশি সমৃদ্ধ হতে পারবে। কিন্তু এ বিপুলসংখ্যক ছেলেমেয়ে এভাবে পিছিয়ে থাকলে সে জাতির সমৃদ্ধির আশা করা বৃথা।

সুতরাং আমাদের এই ত্রিমুখী শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় সাধন প্রয়োজন। এ জন্য আমাদের একটি প্ল্যাটফর্মে এসে একটি পরামর্শভিত্তিক সিলেবাস প্রণয়ন করা প্রয়োজন। যাতে সবাই একটি সমান মৌলিক জ্ঞানের অধিকারী হয়ে রাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অঙ্গনে সমভাবে অবদান রাখতে পারে।

লেখক: শিক্ষার্থী ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৯/১০/২০২৩    

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়