ঢাকাঃ ‘ডাকাত খাতে লুণ্ঠিত’ এ রকম খাতে প্রতি মাসে ৬৫ হাজার ৩০ টাকার হিসাব লেখা হয় ক্যাশবুকে। তবে এর কোনও ব্যাখ্যা নেই। ‘বেনাভোলেন্ট ফি’ নামে প্রতি মাসে ৬০০ টাকা করে আদায় করা হয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। শিক্ষকদের কাছ থেকেও নেওয়া হয় বেতনের ৫ শতাংশ হারে। কিন্তু এ পর্যন্ত মোট কত টাকা আয় হয়েছে তার উল্লেখ নেই। শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি’র টাকায় ব্লেজার কিনেছেন গভর্নিং বডির সভাপতিসহ সদস্যরা। এছাড়াও নানা রকম ভাতা তুলে নিচ্ছেন তারা। করোনার লকডাউনের সময় প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, কিন্তু ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬৪ লাখ ৬৪ লাখ ২৩ হাজার ৫৮১ টাকা। বেআইনিভাবে তফসিলি ব্যাংকের বাইরে দুটি বেসরকারি ব্যাংকে রাখা হয়েছে ৭০ কোটি টাকা।
এই সব অভিযোগসহ নানা রকম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিরুদ্ধে। দুর্নীতির অভিযোগ সেখানে নতুন কিছু নয়। তবে নতুন করে এক প্রতিবেদনে আর্থিক অসচ্ছতার বড় চিত্র উঠে এসেছে।
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মোট শিক্ষক-কর্মচারী ৭৮৭ জন। এর মধ্যে মূল ক্যম্পাস মতিঝিলে শিক্ষক-কর্মচারী ৩৮৫ জন, বনশ্রী শাখায় শিক্ষক-কর্মচারী ২৭২ জন এবং মুগদা শাখায় শিক্ষক-কর্মচারী ১৩০ জন। প্রতিষ্ঠানটিতে মাধ্যমিক স্তরে বাংলা ভার্সনে শিক্ষার্থী ৬ হাজার ৪০০ জন এবং ইংরেজি ভার্সনে ২ হাজার ১৩৯ জন। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ১ হাজার ১৬১ জন। প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে চলা প্রতিষ্ঠানটিতে আয়-ব্যয়ও বড় অংকের।
সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ)। গত ১৬ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ডিআইএ। প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটির নানা খাতে দুর্নীতির চিত্র উন্মোচিত হয়েছে।
পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার বলেন, প্রায় প্রতিটি খাতেই ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতির পাওয়া গেছে। ভ্যাট উৎসে করও দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। আত্মসাৎ ও দুর্নীতির টাকা সরকারি কোষাগার ও প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
সব শাখায় টাকা আত্মসাৎ
প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালের ৩০ জুন থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির মূল ক্যাম্পাসের কলেজ শাখা থেকে ১১ লাখ ৬৭ হাজার ২৯০ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। আর মাধ্যমিকের বাংলা মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে ৫ কোটি ৪৩ লাখ ৪৮ হাজার ৩৪৫ টাকা। এছাড়া ইংরেজি মাধ্যমে গড়মিল রয়েছে ৮০ লাখ ১৪ হাজার ৭০০ টাকা।
মুগদা শাখায় আত্মসাৎ হয়েছে ২ কোটি ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৩১৬ টাকা। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মুগদা শাখায় নগদ টাকা হাতে রেখে ৪ কোটি ৫৯ লাখ ৩২ হাজার ১১ টাকা খরচ করা হয়েছে, যা বিস্ময়ের উদ্রেক করে।
প্রতিষ্ঠানটির বনশ্রী শাখায় বাংলা মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে ৫ কোটি ১৯ লাখ ৫ হাজার ৯০২ টাকা এবং ইংরেজি মাধ্যম থেকে আত্মসাৎ হয়েছে ৯৪ লাখ ৮৪ হাজার ১৯৭ টাকা।
অতিরিক্ত ফি আদায়
প্রতিষ্ঠানের সব ব্রাঞ্চে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ সাধারণ ও সংরক্ষিত তহবিলে টাকা জমা আছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এরপরও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন খাতে অপ্রয়োজনীয় কারণে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন ফি আদায় করা হচ্ছে। টিউশন ফি’র পরিমাণও যথেষ্ট বেশি বলে পরিদর্শন দল মনে করে। ভর্তি ফি ও মাসিক টিউশন ফিসহ মোট ২০ টি খাতে ফি আদায় করা হয়। মাসিক ভিউশন ফি বাবদ ১৫০০ টাকা, উন্নয়ন বাবদ ২০০০ টাকা এবং দালান মেরামত ও সংস্কার বাবদ ২৩৫ টাকা আদায় করা হয়। এটা অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করেছে। তাই অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি এবং অন্যান্য ফি আদায়ের হার কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
বেআইনিভাবে ৭০ কোটি টাকা বেসরকারি ব্যাংকে
তফসিলি ব্যাংকে হিসাব খোলার কথা থাকলেও আইন অমান্য করে বেসরকারি ব্যাংকে ৭০ কোটি টাকা জমা করা হয়েছে। বেসরকারি ইউনিয়ন ব্যাংকে ৫০ কোটি এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ২০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে।
সম্মানী খাতে ব্যয়
২০১৩ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মতিঝিল ক্যাম্পাসের জন্য সম্মানী খাতে সাধারণ ব্যয় হয়েছে ১১ কোটি ১৮ লাখ ৬৪ হাজার ৯৬১ টাকা। এছাড়া গভর্নিং বডিকেই সাধারণ সম্মানী দেওয়া হয়েছে আরও ৬ লাখ ৫৭ হাজার ৩৮৭ টাকা।
গভর্নিং বডির সম্মানী
প্রতিটি ব্রাঞ্চ থেকে পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সদস্যরা আর্থিক বিধিতে প্রভিশন না থাকা স্বত্ত্বেও সম্মানী ভাতা নিয়েছেন ৩৩ লাখ ২৩ হাজার ৩৮৬ টাকা।
২০১৪ সাল থেকে গভর্নিং বডির সভাপতি ও সদস্যরা কন্টিজেন্সি ভাতা নিয়েছেন ৩১ লাখ ৬৭ হাজার ৯৬৭ টাকা।
পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য মতিঝিলের ক্যম্পাসের কলেজ শাখা থেকে গভর্নিং বডির সভাপতি ও সদস্যরা সম্মানী ভাতা নিয়েছেন ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
গভর্নিং বডির সভায় উপস্থিত থাকলে সভাপতি সম্মানী পান ২৫ হাজার টাকা। আর সদস্যরা পান ৬ হাজার টাকা। আর সভার কাজে সহযোগিতার জন্য অফিস সহকারীরা পান ৩ হাজার করে। সভাপতির সেলফোন বাবদ মাসিক বিল দেওয়া হয় ৫ হাজার টাকা।
প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ জানায়, আগে সদস্যদের ভাতা ছিল ৩ হাজার এবং সভাপতির ভাতা ছিলো ৫ হাজার। বর্তমান সভাপতির আসার পর ২০২২ সালে নতুন করে সম্মানী ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হয়।
আপ্যায়ন ব্যয়
২০১২-২০১৩ থেকে ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে বাংলা ভার্সনে আপ্যায়ন ব্যয় ২ লাখ ১ হাজার ৬১৮ টাকা। ইংরেজি ভার্সনে আপ্যায়ন ব্যয় ২ লাখ ৫ হাজার ২০৪ টাকা। মতিঝিল কলেজ শাখায় আপ্যায়ন ব্যয় ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৪৪৭ টাকা। বনশ্রী বাংলা মাধ্যমে আপ্যায়ন ব্যয় ১ লাখ ৬১৫ টাকা। ইংরেজি ভার্সনে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৪৬৯ টাকা। মুগদা শাখায় আপ্যায়ন ব্যয় ২ লাখ ৮ হাজার ৯৩৩ টাকা।
এছাড়া গভর্নিং বডিকে আপ্যায়ন ব্যয় বাবদ দেওয়া হয়েছে ৬ লাখ ২০ হাজার ১৩৯ টাকা। মুগদা শাখা গভর্নিং বডিকে আপ্যায়ন ব্যয় বাবদ দিয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৫৪৭ টাকা।
গভর্নিং বডির নির্বাচনি ব্যয়
২০১৯ সাল থেকে ২০২১ এই তিন বছরে গভর্নিং বডির নির্বাচনে ব্যয় হয়েছে ৩৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৫২ টাকা।
পরিচালনা কমিটির নির্বাচনের প্রস্তুতি সভার নামে পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সদস্যরা সম্মানী নিয়েছেন। ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল শুধু মুগদা শাখা (বাংলা) থেকে নেওয়া হয়েছে ৬৬ হাজার টাকা।
পরিচালনা কমিটির উন্নয়ন কাজের লিফলেট ছাপানো বাবদ মতিঝিল ইংরেজি ভার্সনের কাছ থেকে খরচ করা হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা।
বেতনের বাইরে অধ্যক্ষের ভাতা দেড় কোটির বেশি
বেতনের অতিরিক্ত হিসেবে তিন ক্যম্পাস থেকে অধ্যক্ষ দায়িত্ব ভাতা ও বাৎসরিক ভাতা হিসেবে নিয়েছেন ১ কোটি ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার ৩৭ টাকা। মতিঝিল ক্যাম্পাস থেকে বাংলা ভার্সনের জন্য দায়িত্ব ভাতা নিয়েছেন ৩৬ লাখ ৬ হাজার টাকা, আর বাৎসরিক ভাতা নিয়েছেন ৩ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। ইংরেজি ভার্সনের জন্য দায়িত্ব ভাতা নিয়েছেন ২৮ লাখ ৭৩ হাজার ৩৬ টাকা এবং বাৎসরিক ভাতা নিয়েছেন ৩ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।
মতিঝিল ক্যম্পাস ছাড়াও বনশ্রী ও মুগদা শাখা থেকে ২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বেতনের অতিরিক্ত অধ্যক্ষ দায়িত্ব ভাতা ও বাৎসরিক ভাতা নিয়েছেন ৯৫ লাখ ৬৩ হাজার এক টাকা।
সহকারী প্রধান শিক্ষকরা বিভিন্ন সময় বেতনের অতিরিক্ত মাসিক ভাতা ও বাৎসরিক ভাতা নিয়েছেন ১ কোটি ৯৯ লাখ ১১ হাজার ১৪৪ টাকা।
শিক্ষকদের অতিরিক্ত টাকা উত্তোলন
প্রতিষ্ঠানটির ১৭ জন এমপিওভুক্ত শিক্ষকের জন্য অতিরিক্ত উত্তোলন করা হয়েছে ২২ লাখ ২ হাজার ১৪০ টাকা যা সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। নন-এমপিও শিক্ষকদের মধ্যে ৫ জন অতিরিক্ত উত্তোলন করেছেন ৩০ লাখ ২৭ হাজার ১৪০ টাকা, এটাও ফেরত দিতে সুপারিশ করা হয়েছে।
জেনারেটর ও জ্বালানি বাবদ ব্যয়
মূল ক্যম্পাস মতিঝিলে ১০১২-২০১৩ অর্থ বছর থেকে ২০২১-২০২২ সাল পর্যন্ত জ্বালানি খাতে ব্যয় করা হয়েছে ১১ লাখ ৬৬ হাজার ৪৭২ টাকা। মুগদা শাখায় ২০১২-২০১৩ থেকে ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে জ্বালানি বাবদ ব্যয় করা হয়েছে ৪ লাখ ৬২ হাজার ২৮৯ টাকা। আর মেরামত বাবদ ব্যয় করা হয়েছে ৯ লাখ ৭৬ হাজার ১৭৬ টাকা।
নগদ টাকা ব্যয়
নগদ টাকা হাতে রেখে খরচ করা হয়েছে ৭৮ কোটি ৪১ লাখ ২৭ হাজার ৩১৭ টাকা।
বেনাভোলেন্ট ফি
‘বেনাভোলেন্ট ফি’ নামে প্রতি মাসে ৬০০ টাকা করে আদায় করা হয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। শিক্ষকদের কাছ থেকে নেওয়া হয় বেতনের ৫ শতাংশ হারে। কিন্তু এ পর্যন্ত মোট কত টাকা আয় হয়েছে তার উল্লেখ নেই। এই খাতে ২০১২-২০১৩ থেকে ২০২১-২০২২ অর্থবছর পর্যন্ত মোট আয় ৭ কোটি ৪০ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৭ টাকা। কিন্তু ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি ৫৭ লাখ ১৯ হাজার ৮২১ টাকা। অতিরিক্ত ৩ কোটি ১৬ লাখ ৩৮ হাজার ৫৪ টাকা কোন খাত থেকে এনে খরচ করা হয়েছে তার কোনও উল্লেখ নাই।
মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. মিজানুর রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও ফোন রিসিভ করেননি। মেসেজ দিলেও কোনও জবাব দেননি তিনি।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৪/১০/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়