জ্ঞানভিত্তিক সমাজে জ্ঞানচর্চা

।। আনিসুর রহমান এরশাদ।।

জ্ঞানভিত্তিক সমাজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগার ও গবেষণাগার থাকবে, পরিবারগুলোতে পারিবারিক লাইব্রেরি থাকবে, সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থাকবে, এমন কোনো গ্রাম থাকবে না যেখানে গ্রন্থাগার থাকবে না, মসজিদসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও গ্রন্থাগার থাকবে, শহরে এমন কোনো উঁচু উঁচু দালান থাকবে না যেখানে কমন পাঠক কর্নার বা রিডার কর্নার থাকবে না।

জ্ঞানভিত্তিক সমাজের মানুষ সনদমুখী শিক্ষাতে সন্তুষ্ট হয় না, গবেষণায় মনোযোগী ও জ্ঞানচর্চার স্বার্থে প্রতিষ্ঠান গড়তে উৎসাহী, জ্ঞানচর্চার জোয়ারে পঠনপাঠন ও চিন্তা-ভাবনা বাড়াতে আগ্রহী। এই সমাজে নানা ধরনের বিষয়ভিত্তিক সংগ্রহশালা ও বিভিন্ন দরকারী যন্ত্রপাতি বেশি মূল্য পায়।

যারা সত্যিকারার্থেই জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার তাগিদ ভেতর থেকে অনুভব করেন- তারা মুখস্থবিদ্যার সম্প্রসারণের চেয়ে যুক্তিবাদী মন তৈরিকে গুরুত্ব দেন, যথাযথ ব্যাখ্যা হাজির করতে সচেষ্ট থকেন, কোনো বিষয়ে খণ্ডিত-আংশিক-বিচ্ছিন্ন ধারণার চেয়ে সম্পূর্ণ জানাকে দরকার মনে করেন, প্রশ্ন উত্থাপনকে উৎসাহিত করে উত্তর দানে আন্তরিক থাকেন, সমালোচনায় সময় নষ্ট না করে তুলনামূলক আলোচনা ওগঠনমূলক কাজে ব্যস্ত থাকেন; প্রকৃত জ্ঞানচর্চা প্রয়োজনীয় বা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়।

জ্ঞানভিত্তিক সমাজের মানুষ- অন্যের জ্ঞানের দাসত্ব করে না, অন্যে জ্ঞানের অনুকরণ করে না, নিজেরা নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে, স্বাধীনভাবে জ্ঞানচর্চা করে। জ্ঞানচর্চায় আছে মানেই প্রাণবন্ত আছে, প্রাণশক্তি আছে, কৌতূহল আছে, অনুসন্ধিত্সা আছে, জিজ্ঞাসা আছে, জ্ঞানের জগতে মৌলিক অবদানের সাহস আছে, হাতে-কলমে পরীক্ষা করার মনোভাব আছে।

জ্ঞানভিত্তিক সমাজে বিজ্ঞানের ল্যাবভিত্তিক কাজগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হয় না, সমাজবিজ্ঞানের কাজকেও অবহেলা করা হয় না, কলা ও মানবিকী বিদ্যা জাগতিক চর্চাকেও মূল্যহীন ভাবা হয় না। সমাজবিজ্ঞান ও কলা অনুষদের বিভাগগুলোতে অধ্যয়নকারীদের চাকরির বাজারে দাম অপেক্ষাকৃত কম হলেও জাতির সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক নির্দেশনা তাদের কাছ থেকেই আসে বলে এদের প্রকৃত মূল্য অনেক বেশি।

জ্ঞানভিত্তিক সমাজে জ্ঞানচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্টরা মুখিয়ে থাকেন। প্রযুক্তি ব্যবহারে এগিয়ে থাকার মাধ্যমে, বিজ্ঞানচর্চার যথার্থ অবকাঠামো তৈরি করে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরি সম্ভব। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রকে গুরুত্ব এমনভাবে দিতে হবে যে ফ্ল্যাটগুলোতেও পড়াশোনার জন্য আলাদা বন্দোবস্ত থাকবে; এমন কোনো বসতবাড়ি থাকবে না যেখানে পড়াশোনার জায়গা থাকবে না।

নিয়মিত বই কিনে বইকেনার প্রবণতা উৎসাহিত করতে হবে, নতুন নতুন বই না আসলে বইপড়ার প্রবণতা নিরুৎসাহিত হবে। কম্পিউটার ল্যাব বা লাইব্রেরি গড়ে তোলা দায়সারা ভাবে না করে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে করতে হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নে সার্বিক কৌশল এমন হবে যে বইপড়া একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হবে, সচেতনতা বাড়াতে সমন্বয় বাড়বে ও চাহিদা অনুযায়ী বাস্তবানুগ দক্ষতা বাড়াতে সহযোগিতা সুদৃঢ় হবে।

পেশাগত কাজকে সূচারুভাবে সম্পন্ন করতে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়াতে হবে। বিভিন্ন ট্রেনিং কোর্স প্রবর্তন করে একটি মেধাভিত্তিক আলোকিত সমাজ গড়ে তোলতে হবে। মেধাজাত সম্পদ সৃষ্টি, তার সুরক্ষা এবং বিকাশের মাধ্যমে অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু অঙ্গীকার যথেষ্ট নয়; সকলেরই তথ্য ও জ্ঞানে অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা দরকার।

দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ সৃষ্টি করলে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। সমাজে সৎ ও শিক্ষিত মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় নেই। উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম আলোকিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিকশিত করা, সমাজের বাস্তব চিত্র থেকে শেখানো, উন্নত ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়তে জ্ঞানের আলোকে আত্মস্থ করানো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্বমানের গ্র্যাজুয়েট তৈরি এবং জীবনের জন্য যথাযথ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম ০২/০৩/২৩ 

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়