জেমস বন্ড থেকে নয়ন বন্ড, বিচার চাইবো কার?

নাজমুল রানা।।

কী লিখবো? কী লেখা যায়, আসলে কিইবা লেখার আছে? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে খুঁজতেই মিনিটের কাঁটা ঘণ্টা ছোঁয়; দিনের টিকটিকি পৌঁছে যায় রাতে। রাতও বাড়ে ঘড়ির কাঁটায়, মাঝ রাতে খবর পাই ক্রসফায়ার। আর ক্রসফায়ার মানেই সেই গতানুগতিক গল্প। ক্রসফায়ারের ইতিহাস যুগ পেরুলেও এই গল্পটা পাল্টায়নি একদম। বরং হয়ে উঠেছে শ্বাশত সত্য।

অপরাধীর উপস্থিতি টের পেয়ে অভিযানে যায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারপর কী? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে গুলি ছোড়ে কাঙ্ক্ষিত সন্ত্রাস। এরপর প্রাণ রক্ষায় পাল্টা গুলি ছুড়তে বাধ্য হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ব্যস খেল খতম! কখনো পুলিশের তালিকাভূক্ত সন্ত্রাসীর মাথা, কখনো বুক ঝাঁঝরা করে বেরিয়ে যায় বুলেট। নিথর শরীরে পড়ে থাকা অপরাধী পায় নির্বাণ, আর আমরা পরদিন পত্রিকায় পড়ি সেই একরৈখিক গল্প। খালি হতাহতের নামে বদল আসে এই যা। এর বাইরে নতুন বলে থাকে না আর কিছুই।

অবশ্য এই গল্পে আমাদের কিছু যায় আসে না। আমরাও অধিকাংশ সময় এই গল্পের সত্যাসত্য যাচাই করতে যাই না। ভাবি যা বলছে বলুক, তাতে আমাদের কী। আবার এই গল্পকে শতভাগ সত্য বলতেও নারাজ আমরা। কেউ কেউ তো বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলি এই ক্রসফায়ার নাটকের চিত্রনাট্যটা এবার বদলানো উচিৎ। তারপরও মেনে নেই, ভাবি যা ঘটে ঘটুক; আপাতত আমি তো নিরাপদ। এই নিরাপদবোধ একদিন আমাকেও বুলেটের মুখে ঠেলে দেয়, তখন হয়তো বলতে চাই ‘বন্ধ করো এই নাটক, সব ঝুট হ্যায়’। তবে সময় পাই না। বুলেট যে বুকের সাথে নিথর করে দেয় কণ্ঠস্বর। আমি যখন লাশ হয়ে পড়ে থাকি, তখন সবাই একই ভাবনা ভাবে। মনে মনে বলে, ‘যা হচ্ছে হোক, আমি তো নিরাপদ।’ দিন গড়ায়, বন্দুকযুদ্ধে নিহত মানুষের সারিতে যোগ হয় নতুন নতু নাম। একই গল্প চলতে থাকে পরম্পরায়…

২ জুন, ভোর রাতে এমনই এক বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে নয়ন বন্ড। জেমস বন্ডের একাট্টা এই ভক্তের কর্মকাণ্ডও নাকি বন্ড সিরিজের নায়ক জেমস বন্ডের মতো ভয়াবহ। এতিম শিশুর খুনি হয়ে ওঠার এক দুর্ধর্ষ গল্প নয়ন বন্ডের জীবনের পরতে পরতে। জেমস বন্ডের আদলে সে গড়েছিলো জিরো জিরো সেভেন বাহিনী। সেখান থেকেই চলতো তার সকল বন্ডিয় কর্মকাণ্ড। শত খুন করার পরও জেমস বন্ড আজীবন নায়ক হিসেবে থাকলেও নয়ন বন্ড মরেছে খলনায়কের তকমা নিয়ে। কারণ, সে মরেছে নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রাষ্ট্রের নয়।

রাষ্ট্রের এজেন্ডা বাস্তবায়নে যারা জেমস বন্ডের মতো রোজ মানুষের বুক ঝাঁঝরা করে তারা এদেশে এখনো ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে সমাদৃত। তাদের জন্য আমাদের ভালোবাসা অফুরাণ, তাদের পরিবর্তনহীন চিত্রনাট্যও আমাদের ভালো লাগে, বিচলিত করে না। কিন্তু নয়নদের মতো ক্ষুদে বন্ড/খুনিদের কর্মকাণ্ড আমাদের বিচলিত করে। তাকে আইনের আওতায় না এনে মেরে ফেলাই শ্রেয় মনে হয়। আমজনতাও ধ্বনি তোলে, ‘ওকে ক্রসফায়ারে দেয়া হোক’ ‘ওকে নিয়ে এখনো অস্ত্র উদ্ধারে যাচ্ছে না ক্যারে’। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই মাতম বেশি ওঠে।

আমরা সবাই জেমস বন্ডের গল্প জানি, যার অনুপ্রেরণায় জন্ম নেয় শত শত নয়ন বন্ড। কিন্তু জেমস বন্ড কাদের তৈরি, এই খুনিকে নায়ক প্রতীয়মান করার নেপথ্যে কারা সেটা জানি কী? জানতে চাই কী? বন্ডকে নায়ক বানিয়েছে আমেরিকা, এর হাতে নানা প্রযুক্তি আর অস্ত্র তুলে দিয়ে প্রপাগান্ডা চালিয়ে বাস্তবায়ন করছে নিজেদের এজেন্ডা। ভার্চুয়াল বা সেলুলয়েডে বিরোধী নিধনে বন্ডের চেয়ে সাধু হাতিয়ার আর আমেরিকার হাতে নেই। কিন্তু জেমসের বন্ডের ভক্ত কিংবা শত্রু সবাই কৃতিত্ব কিংবা শয়তানীর জন্য পর্দার বন্ডকেই গালি দেন, আমেরিকাকে নয়। ঠিক তেমন জঘন্য কর্মকাণ্ডের জন্য নয়ন বন্ডের ক্রসফায়ারকে বৈধতা দিয়ে চলেছি আমরা। তার ক্রসফায়ারকে যুক্তিযুক্ত বলে ফেসবুকে পোস্ট দেই, বাইট দেই টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে।

ব্যতিক্রম কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশই প্রশ্ন করি না, দারিদ্র্য আর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কারা অতিসাধারণ নিরীহ নয়নকে নয়ন বন্ড বানান। কার ছত্রছায়ায় মাদক ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে নয়ন, কার তদবিরে মেলে নয়নের কারামুক্তি। যে অস্ত্র দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লক্ষ্য করে নয়ন বন্ডরা সেই অস্ত্রটাই বা আসে কোত্থেকে? কে ফায়দা লোটে এই ক্ষুদে বন্ডদের কাজে লাগিয়ে? রিফাত শরীফকে যে অস্ত্র দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করেছে নয়ন, সেই রামদা-ই এলো কোত্থেকে? কারা নয়নকে দিলো এমন অমোঘ সাহস? গণমাধ্যমের সুবাদে নয়নের আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতাদের কয়েকজনের নাম উঠে আসলেও সেদিকে কারো নজর নেই। বরং আমরা দেখেছি, নয়নের আশ্রয়দাতা হিসেবে পরিচিত মানুষটিই নিজের গা বাঁচাতে দাঁড়িয়েছেন, রিফাত শরীফ হত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত মানবন্ধনে।

ঊঁচু গলায় নয়নের বিচার চেয়ে দিয়েছেন ভাষণেও। কিন্তু তার বিচার চাইবে কে? মানবন্ধনে উপস্থিত সবাই জানেন, কার জোরে ক্ষুদে ভোলতা থেকে ভীমরুল হয়ে উঠেছে নয়ন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে মানবন্ধনের বক্তব্যে কেউ এই ভাসুরদের নাম মুখে আনেননি বরং তাদের সুরে সুর মিলিয়েছেন। আসলে সুর না মিলিয়ে উপায়ও নেই। এ দেশে তো এখন মুখ খুলে নিঃশ্বাস নেওয়াটাই বড়ো ঝুঁকির বিষয়। কিছু বললেই তো গুম, খুন, নিপীড়ন ও হুমকি। নাম বললে শুধু চাকরি নয় জীবনই না থাকবে না। সেই জীবন হারানোর ঝুঁকি নিয়ে কথা বলতে যাবো কেনো? সে প্রশ্ন তো উঠতেই পারে।

তবে হতাশার বিষয় মুখ বুজে থেকেও তো প্রাণ বাঁচানো যায় না সবসময়। ‘প্রয়োজনে যারতার গলা কাটো’ আপাতত সেই নীতিতেই চলছে দেশ। তাই রিফাতের মায়ের চোখ যেমন ভাবায়, তেমন ভাবায় নয়নের মায়ের অশ্রুস্নাত নয়ন। মা তো মা-ই। সব মায়ের নয়নাশ্রুর ওজনও তো এক। রিফাত হত্যার বিচার যেমন চাই, তেমন চাই নয়ন হত্যারও বিচার হোক। রিফাত হত্যার জন্য নয়ন কাঠগড়ায় দাঁড়াবে, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবে; উভয় পক্ষের বক্তব্য ও সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত সিদ্ধান্ত নেবে নয়ন বন্ড ফাঁসিতে ঝুলবেন নাকি পাবে যাবজ্জীবন সাজা। এমনটাই তো কথা ছিলো। কিন্তু সেটা কেনো করা গেলো না?

নিউজিল্যান্ড যদি ক্রাইস্টচার্চ হামলার দুর্ধর্ষ কারিগর ব্রেন্টন ট্যারান্টকে জীবিত ধরতে পারে, আমাদের পুলিশ কেনো নয়নের মতো ক্ষুদে বন্ডকে জ্বলজ্যান্ত অবস্থায় আদালতে হাজির করতে পারে না। আসলে পারে না নাকি পারতে চায়-ই না। নয়ন জীবিত ধরা পড়লে বেরিয়ে আসতে পারতো আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য, জানা যেতো নয়ন বন্ডের কারিগরদের নাম। সেকারণেই কী নয়নদের নিথর করে দেয়া হয় মাঝ রাতে, বুলেট বাঁচিয়ে দেয় আসল পাপীদের? তাই রিফাত হত্যার বিচারের পাশাপাশি আমি নয়ন হত্যার বিচারও চাই। চাই সুষ্ঠু তদন্ত। বেরিয়ে আসুক থলেতে লুকিয়ে থাকা সব কালো বিড়াল, নয়নাশ্রুতে আর কোনো মায়ের বুক না ভিজুক।

লেখক ও সাংবাদিক