জালিয়াতি করে ১৩ বছর ধরে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেন

উপাধ্যক্ষ পদে এমপিওভুক্ত হতে না পারলেও অধ্যক্ষ পদে এমপিওভুক্ত হয়ে করছেন সরকারি অর্থের তছরুপ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ বিধিমালায় না থাকলেও এমপিওভুক্ত মাদ্রাসার সহকারী মৌলভী থেকে পদায়ন পেয়ে সরাসরি প্রভাষক, সেখান থেকে উপাধ্যক্ষ এবং উপাধ্যক্ষ পদে এমপিওভুক্ত হতে না পারলেও তথ্য গোপন করে মোটা অংকের অর্থের মাধ্যমে অধ্যক্ষ হয়ে (এমপিওভুক্ত হয়ে) এক যুগের বেশি সময় ধরে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে এক অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। অভিযোগের পর অভিযোগ তদন্তের পর তদন্ত অথচ তিনি আজও বহাল তবিয়তে আছেন। তিনি হচ্ছেন বগুড়ার নন্দীগ্রামে ইসলামপুর ভূস্কুর সিদ্দিকীয়া সিনিয়র আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোঃ মোশাররফ হোসেন।

শিক্ষাবার্তা’র অনুসন্ধানে ও একাধিক তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, অধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেন ১৯৮৯ সালে বগুড়া জেলার ধুনট উপজেলার নাংলু এম কে এম ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসায় সহকারী মৌলভী পদে নিয়োগ পান এবং এমপিওভুক্ত হন। এরপর ১৯৯৭ সালে কোনো ধরণের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এবং নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়া সরাসরি (শুধুমাত্র কমিটির রেজুলেশনের মাধ্যমে) প্রভাষক (আরবি) পদে পদায়ন করা হয়। অর্থ্যাৎ বিধিতে না থাকলেও তিনি সহকারী মৌলভী থেকে সরাসরি পদায়ন পান প্রভাষক পদে। ১৯৯৭ সালের পহেলা জুন প্রভাষক (আরবি) পদে যোগদান করেন এবং একই বছরের ১৯৯৭ সালের আগস্ট মাসে এমপিওভুক্ত হন।

১৯৯৫ সালের এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো অনুযায়ী, ১৯৯৫ সালের আগের মাদ্রাসার বিদ্যমান পদসমূহের মধ্যে কিছু বিলুপ্ত হয়। বিলুপ্ত পদে কর্মরত শিক্ষকগণ উদ্বৃত্ত শিক্ষক হিসেবে ঘোষিত হন। এমতাবস্থায় ১৯৯৫ এর জনবল কাঠামো জারীর ফলে সৃষ্ট পদে এবং বিদ্যমান পদ শূন্য হলে তদস্থলে উদ্বৃত্ত ঘোষিত শিক্ষকদের মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সভার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে পদায়ন করার নিদের্শনা রয়েছে। মূলত ১৯৯৫ এর জনবল কাঠামো বিধি জারীর ফলে যে পদ বিলুপ্ত হয়নি তাহা উদ্বৃত্ত পদ হিসেবে গণ্য হবে না। বিধায় উক্ত পদে কর্মরত কোন শিক্ষক পদায়নের সুযোগ পাবেন না। অর্থ্যাৎ যে পদ বিলুপ্তি হয়েছে সেই পদের বিপরীতে যোগ্যতা সাপেক্ষে শুধুমাত্র শূন্য পদে পদায়ন পাবেন।

 মোঃ মোশাররফ হোসেন নাংলু এম কে এম ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসায় বিজ্ঞপ্তি ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে ১৯ অক্টোবর ১৯৮৯ ইং তারিখে সহকারী মৌলভী পদে যোগদান করেন। মাদ্রাসাটির আরবী প্রভাষক মোঃ নজরুল ইসলাম ১৯৯৭ সনে প্রভাষক পদে ইস্তেফা প্রদান করলে পদটি শূন্য হয়। এরপর ১৯৯৫ সালের জনবল কাঠামো জারীর পর বিজ্ঞপ্তি এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ব্যতীত শুধুমাত্র পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রভাষক (আরবী) শূন্য পদে পদায়ন লাভ করেন। যা বিদি সম্মত নয়। কারণ ১৯৯৫ সনের জনবল কাঠামোয় বাংলাদেশের কোনো মাদ্রাসায় সহকারী মৌলভীর পদটি বিলুপ্ত হয়নি। অর্থ্যাৎ নীতিমালা অনুযায়ী বর্তমান অধ্যক্ষ মোঃ মোশাররফ হোসেন এর প্রভাষক পদে পদায়ন সম্পূর্ণ অবৈধ। নীতিমালা অনুযায়ী, প্রভাষক পদে অবৈধ হলেও মোঃ মোশাররফ হোসেন ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১১ তারিখ পর্যন্ত প্রভাষক পদে কর্মরত ছিলেন এবং সরকারের এমপিও অংশ উত্তোলন করেছেন। এরপর তিনি ১৪ ফেরবুয়ারি ২০১১ ইং তারিখে নিয়োগ বোর্ডের সুপারিশক্রমে ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১ইং তারিখের নিয়োগের প্রেক্ষিতে কর্মরত একই মাদ্রাসায় উপাধ্যক্ষ পদে (২০ ফেব্রুয়ারি ২০১১ ইং তারিখে) যোগদান করেন। তবে এখানেও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে উপাধ্যক্ষ পদ বাগালেও আরবি প্রভাষক পদে অবৈধভাবে চাকরি করার বিষয়টি সামনে আসে উপাধ্যক্ষ পদের এমপিওভুক্তির সময়। তার আরবি প্রভাষক পদে পদায়ন অবৈধ হওয়ায় তিনি উপাধ্যক্ষ পদে এমপিওভুক্ত হতে পারেননি।০১ ডিসেম্বর ২০১১ ইং তারিখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে আরবি প্রভাষক পদে অবৈধভাবে পদায়নের বিষয়টি সামনে আসে। ২৩ এপ্রিল ২০১২ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (বিশেষ) স্বাক্ষরিত পত্রে জানানো হয়, বগুড়া জেলার ধুনট উপজেলাধীন নাংলু এম.কে.এম ফাযিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ পদে মোঃ মোশাররফ হোসেন এর এমপিওভুক্তিতে উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্টের পূর্বেকার নিয়োগে জটিলতা থাকায় বর্তমানে উপাধ্যক্ষ পদে এমপিওভুক্তির সুযোগ নেই- মর্মে তাঁকে অবহিত করা হল।

আরবি প্রভাষক পদে অবৈধভাবে পদায়নের ফলে উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পেয়েও এমপিওভুক্ত হতে না পেরে এখানেই থেমে থাকেননি মোঃ মোশাররফ হোসেন। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১১ ইং তারিখে উপাধ্যক্ষ পদে নাংলু এম.কে.এম. ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসায় যোগদান করে ২৩ এপ্রিল ২০১২ ইং তারিখ পর্যন্ত এমপিওভুক্ত হতে না পারলেও ২৩ এপ্রিল ২০১২ ইং তারিখে একই জেলার নন্দীগ্রাম উপজেলার ইসলামপুর ভূস্কুর সিদ্দিকীয়া সিনিয়র আলিম মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ বাগিয়ে নেন এবং ২০১২ সালের নভেম্বর এমপিওভুক্ত হোন।

অধ্যক্ষ মোঃ মোশাররফ হোসেন গত ২৩ এপ্রিল ২০১২ ইং তারিখে উপাধ্যক্ষ পদে এমপিওভুক্তি সুযোগ নাই মর্মে অবগতপত্র নাংলু এম কে এম ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার অফিসে প্রেরিত হয়, উক্ত একই তারিখে ইসলামপুর (ভূক্ষুর) সিদ্দিকিয়া সিনিয়র আলিম মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। ০১ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে প্রভাষক পদ অবৈধ হওয়ার পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয় এবং ২০১২ সালের ২২ মে ইং তারিখে  শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক তার বেতন ভাতা স্থগিত সহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশনামূলক চিঠি প্রেরণ করা হয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তরের চিঠি আদেশ-নিষেধ অতি সুচারু কৌশলে অবলম্বন করে মোঃ মোশাররফ হোসেন ইসলামপুর (ভূকুর) সিদ্দিকিয়া সিনিয়র আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে নভেম্বর ২০১২ মাসে এমপিওভুক্ত হন। এরপর এখন পর্যন্ত তিনি অধ্যক্ষ পদে বহাল তবিয়তে আছেন এবং সরকারের দেওয়া এমপিও অংশ তছরুপ করছেন।

জানা গেছে, ৮ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে মাদ্রাসা শিক্ষ অধিদপ্তরের পরিদর্শক ইমন আমির স্বাক্ষরিত চিঠিতে অধ্যক্ষ মোঃ মোশাররফ হোসেন এর বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করে চিঠি ইস্যু করে। এই তদন্ত কমিটিতে সরকারি মুস্তাফাবিয়া আলিয়া মাদ্রাসা, বগুড়ার সহকারী অধ্যাপক ড. আৰু জাফর মুহাম্মদ ইউসুফ ও একই মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক জি এম শামছুল আলমকে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। ১৭ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখ থেকে ০১ জানুয়ারি ২০২২ তারিখ পর্যন্ত তদন্ত করে মাদ্রাসা অধিদপ্তরে তদন্ত প্রতিবেদন জমাদেন তারা। সূত্র জানিয়েছে, তদন্তে তার অনিয়মের বিস্তারিত উঠে এসেছে এবং অধ্যক্ষ পদে তার নিয়োগ অবৈধ এবং এমপিও পাওয়ার অযোগ্য তা তুলে ধরা হয়েছে।

শিক্ষাবার্তা’র সাথে কথা হয় ইসলামপুর (ভূক্ষুর) সিদ্দিকিয়া সিনিয়র আলিম মাদ্রাসা এবং নাংলু এম কে এম ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার একাধিক অভিভাবক ও শিক্ষকদের সাথে। তারা জানান, যে ব্যক্তির প্রভাষক পদ অবৈধ হওয়ায় উপাধ্যক্ষ পদে যোগদান করেও এমপিওভুক্ত হতে পারেননি তিনি কিভাবে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পেয়ে এমপিওভুক্ত হলেন ? বিষয়টি আমাদের বিস্মিত করেছে। জালজালিয়াতিরও একটি সীমা থাকে। তারা জানান, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর, মাদ্রাসা অধিদপ্তর, উপজেলা, জেলা প্রশাসনের একাধিক তদন্তে অধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেনের অনিয়ম উঠে এসেছে।কোনো এক অদৃশ্য কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে তারা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেন শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। কমিটির মাধ্যমে আমার বেতন বন্ধ রাখা হয়েছে এখন ফের যখন বেতন চালু হতে যাচ্ছে তখন আবার ষড়যন্ত শুরু হয়েছে। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের তদন্তে আরবি প্রভাষক পদে পদায়নে বিধিবহির্ভুত উল্লেখ করা হয়েছে এবং অন্যান্য তদন্তেও বিষয়টি উঠে এসেছে। এছাড়া আপনি উপাধ্যক্ষ পদে এমপিওভুক্ত হতে না পারলে অধ্যক্ষ পদে কিভাবে এমপিওভুক্ত হলেন জিজ্ঞেস করলে, তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

জানতে চাইলে নন্দীগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ হুমায়ুন কবির বলেন, অধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেনের বিষয়টি সম্পর্কে জানি। তার বিষয়ে তদন্ত চলছে তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে তা মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এর বাইরেও কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা নিয়েও খোঁজ নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে বগুড়া জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ হযরত আলী শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, বিষয়টি আমি অবগত আছি। তবে আমার দপ্তরে কোনো অভিযোগ না  আসলে আমি কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করতে পারি না।

জানতে চাইলে বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (আইসিটি ও শিক্ষা) মোছাঃ আফসানা ইয়াসমিন শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আমি বিষয়টি সম্পর্কে একেবারেই অবগত নই। তবে এই বিষয়ে কোনো তথ্য পেলে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করব এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৮/১০/২০২৩

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়