ঢাকাঃ জাতীয়করণকৃত ৩৩৩ কলেজের আত্তীকরণ প্রক্রিয়া দীর্ঘ সাত বছরেও শেষ হয়নি। এর মধ্যে অর্ধেক কলেজ নামে সরকারি হলেও কার্যক্রম চলছে বেসরকারি নিয়মে। এতে সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাড়ে ১৯ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী। এর মধ্যে প্রায় ১৪ হাজার শিক্ষক। আর সাড়ে পাঁচ হাজার কর্মচারী। শুধু শিক্ষক-কর্মচারী নন, আত্তীকরণ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় সাত লাখ শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত। আত্তীকরণ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে শিক্ষক-কর্মচারী সরকারি সুযোগ সুবিধা না পেয়েই অবসরে যাচ্ছেন। অন্যদিকে আত্তীকরণ বিধিমালা-২০১৮ এর অসঙ্গতির কারণে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাও কমে গেছে।
আত্তীকরণ প্রক্রিয়ায় ধীরগতির কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক সংকট ও শিক্ষার্থীদের পাঠদানে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। বেতন গ্রেড কমে যাওয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীরা সম্মানহানি, আর্থিক ক্ষতি ও পদাবনতিসহ নানা সমস্যায় পড়েছেন। ইতোমধ্যে সরকারি চাকরিতে যোগদান না করেই তিন হাজার শিক্ষক-কর্মচারী অবসর গেছেন। এ নিয়ে শিক্ষকরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলেও কর্র্তৃপক্ষের টনক নড়েনি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নতুন সরকারি হওয়া কলেজে শুধু শিক্ষক-কর্মচারী নয়, শিক্ষার্থীরাও সমস্যায় পড়েছেন। কলেজ সরকারি হলেও শিক্ষার্থীরা সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আত্তীকৃত যেসব কলেজে শিক্ষকরা যোগদান করেছেন শুধু সেসব কলেজের শিক্ষার্থীরা সরকারি সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। বাকি কলেজের শিক্ষার্থীদের বেসরকারি আমলে ধার্যকৃত বেশি টাকা ফি পরিশোধ করতে হচ্ছে। এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় শিক্ষার্থীরাও জানেন না।
শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ, যুগোপযোগী ও মানসম্মত করার জন্য সরকার দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কলেজ জাতীয়করণ করেছে। সরকারিভাবে ৩৩৩ কলেজ আত্তীকরণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে দাবি করা হলেও কাজ সম্পন্ন হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ। এছাড়াও পদোন্নতি পদসোপান তৈরি, বদলি, এফেক্টিভ সার্ভিস কাউন্ট ইত্যাদি বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা কার্যকর হয়নি। আত্তীকরণ জটিলতায় সরকারিকৃত কলেজের শিক্ষক-কর্মচারী ‘আত্তীকরণ বিধিমালা-২০১৮’ প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পূর্বে ‘আত্তীকরণ বিধিমালা ২০০০’-এর আলোকে আত্তীকরণ করা হতো। এতে প্রভাষকরা বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের মর্যাদা, পদোন্নতি, চাকরিকাল গণনা, পদসোপান, বদলিসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধাদি পেতেন। কিন্তু সরকারিকৃত কলেজসমূহের শিক্ষক-কর্মচারীদের ‘আত্তীকরণ বিধিমালা-২০১৮’ জারির ফলে বিভিন্ন বিধি ও উপবিধির কারণে বেসরকারি আমলে প্রাপ্ত সিলেকশন গ্রেড বা উচ্চতর স্কেল বঞ্চিত হয়ে আর্থিক ও সামাজিক অপূরণীয় ক্ষতিসহ মানসিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। যা তাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টের ও অমর্যাদাকর।
এদিকে ‘আত্তীকরণ বিধিমালা-২০১৮’-এর ৯নং বিধিতে বেতন ভাতাদি নির্ধারণ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘অস্থায়ীভাবে নিয়োগকৃত শিক্ষক-কর্মচারীরা সংশ্লিষ্ট কলেজ সরকারিকরণের তারিখ হতে বিদ্যমান জাতীয় বেতন স্কেলের সংশ্লিষ্ট গ্রেডের প্রারম্ভিক ধাপে স্ব স্ব পদের বেতন ভাতাদি প্রাপ্য হবেন।’ এতে বেসরকারি কলেজের যেসব প্রভাষক আট বছর চাকরি করে উচ্চতর গ্রেড বা সিলেকশন গ্রেড (৯ম থেকে ৭ম গ্রেডে) পেয়েছিলেন এবং বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট পেয়ে যে মূল বেতন আহরণ করেছিলেন সেসব উচ্চতর গ্রেড ও ইনক্রিমেন্ট বাদ দিয়ে আবার সেই চাকরির প্রথম জীবনে প্রবেশকালের প্রারম্ভিক স্কেল ও ধাপে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ক্রীড়া শিক্ষক, প্রদর্শক, লাইব্রেরিয়ান, সহকারী লাইব্রেরিয়ান, অফিস সহকারী ও অফিস সহায়ক পদে যারা আছেন তাদেরকেও একই ভাবে গ্রেড অবনমন করা হয়েছে।
অথচ অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও সহকারী অধ্যাপকদের বেসরকারি আমলে এমপিওতে প্রাপ্ত নিজ নিজ গ্রেডে বেতন ভাতাদি বহাল রয়েছে। অর্থাৎ একই নিয়মে কেউ সুবিধা পাচ্ছেন আবার কেউ বঞ্চিত হচ্ছেন। এই বৈষাম্যের কারণে শিক্ষক-কর্মচারীরা নানা কষ্টে ভুগছেন। জাতীয়করণের কারণে এসব কলেজের অনেক শিক্ষক ১৬ বছর চাকরি করেও সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এসব শিক্ষক নিরুপায় হয়ে সরকারি হওয়া কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করে ৯ম গ্রেডের প্রারম্ভিক ধাপ ২২ হাজার টাকা স্কেলে বেতনভাতা উত্তোলন করতেও বাধ্য হচ্ছেন।
ভুক্তভোগী শিক্ষকরা বলেন, ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কলেজগুলোকে জাতীয়করণের ঘোষণা দিলেও এর মধ্যে ১৪৫টি কলেজের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ২০২৩ সালে এসে ২০০টি কলেজের আত্তীকরণও প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। শিক্ষা, জনপ্রশাসন, অর্থ ও কেবিনেট মন্ত্রণালয়ের ঘাটে ঘাটে দীর্ঘসূত্রতার কারণে শিক্ষক-কর্মচারীদের জীবনে আসা এই দুর্দশা দেখার যেন কেউ নেই। বিষয়টি নিয়ে এক মন্ত্রণালয় আরেক মন্ত্রণালয়কে দুষছে।
জাতীয়করণ হওয়া কলেজসমূহের শিক্ষক কর্মচারী বেতন গ্রেড সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক শামসুল আলম বলেন, আমাদের কোনো দাবিই এ পর্যন্ত পূরণ হয়নি। যে শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকারিকৃত বেতন-ভাতাদির আওতায় আনা হয়েছে তারা প্রাপ্য বেতন গ্রেড থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক। এতে শিক্ষক-কর্মচারীরা কেবল আর্থিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, তাদের মানমর্যাদাও ভূলণ্ঠিত হচ্ছে। আমাদের ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবি পূরণ না হলে বৃহত্তর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হব আমরা।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) প্রফেসর মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, ‘কলেজগুলোর আত্তীকরণ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। যদিও এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া। সংশ্লিষ্ট কলেজের নথিপত্র ঠিক করে আত্তীকরণ প্রক্রিয়া শেষ করতে সময়ের প্রয়োজন হয়। তবে অনেক কলেজের সরকারিকরণ প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। বাদবাকি কলেজের আংশিক কাজ হয়েছে। যেসব কলেজ এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে সেগুলো বেসরকারি নিয়মেই চলছে।’
শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকারিকরণের আগে অবসরে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘তাদের ব্যাপারে সরকার ভাবছে। এ বিষয়ে ভালো সিদ্ধান্ত আসতে পারে।’ শিক্ষক-কর্মচারীদের গ্রেডের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী তাদের পদোন্নতি হবে।’
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৭/১০/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়