জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন: এক কক্ষের বিদ্যালয়

ঢাকাঃ পুরান ঢাকায় জরাজীর্ণ একটি ভবনের এক রুমে চলছে একটি প্রাইমারি স্কুলের কার্যক্রম। এটি পুরোদস্তুর একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুল। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে চলা এক রুমের স্কুলটির নাম মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের লালমোহন সাহা স্ট্রিট এলাকায় ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই স্কুলটি।

স্কুলটি দেখে প্রথমেই মনে হবে, এটা কোনও গোডাউন নয়তো? সাইনবোর্ড থাকায় ‘প্রমাণ’ হয় এখানে একটি স্কুল আছে। তবে নেই কোনও শ্রেণিকক্ষ, খেলার মাঠ, পাঠাগার, নিরাপদ পানির ব্যবস্থা। যারা উপায় না পেয়ে ভর্তি হয়েছিল তারাও এখন স্কুলটি ছেড়ে অন্য কোথাও ভর্তি হওয়ার চেষ্টায় আছে।

পড়ার ন্যূনতম পরিবেশ না থাকলেও কাগজে-কলমে ১০০ জন শিক্ষার্থী তিন জন শিক্ষক ও একজন অফিস সহকারী নিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। জরাজীর্ণ দোচালা এ বিদ্যালয়ে একটি কক্ষেই চলছে ৬টি শ্রেণির পাঠদান। মাঝখানে শিক্ষকদের বসার জায়গা এবং একপাশে শৌচাগার।

শিক্ষক ও অভিভাবকদের দাবি, জনপ্রতিনিধি বা শিক্ষা বোর্ড একটু নজর দিলে স্কুলটিতে অন্তত সুন্দর পরিবেশে পড়াশোনাটা চালিয়ে যাওয়া যেত। স্কুলটিতে সকাল ৯টা ২৫মিনিটে প্লে ২৯ জন, প্রথম শ্রেণীতে ১৬ জন, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ১৪ জন এর ক্লাস শুরু হয়ে শেষ হয় দুপুর ১২টা ৫মিনিটে। আর দুপুর শিফটে ১টা ২৫ মিনিটে তৃতীয় শ্রেণীর ১৩ জন, চতুর্থ শ্রেণীর ১১ জন ও পঞ্চম শ্রেণীর ১৬ জনের ক্লাস শুরু হয়ে শেষ হয় ৩টা ৪৫মিনিটে।

সরেজমিনে গত ৭ নভেম্বর দেখা গেছে, পুরান ঢাকার নারিন্দার লালমোহন সাহা স্ট্রিট এলাকায় ঘিঞ্জি ও সংকীর্ণ রাস্তার এক গলি। সেখানে মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি সাইনবোর্ড ঝোলানো থাকায় ‘প্রমাণ’ হয় এখানে একটি স্কুল আছে। টিনের ছাউনির আধা পাকা ছোট্ট একটি জরাজীর্ণ ভবন। দেয়ালে পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। এক রুমের মধ্যে দুই পাশে তিনটি করে বেঞ্চ বসানো। একসঙ্গে বসে ক্লাস করে দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা।

বারবার অভিযোগ জানিয়েও সমস্যার সুরাহা হচ্ছে না বলে জানান শিক্ষকরা। তারা বলছেন, বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীদের ওই পরিত্যক্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘরে বসেই পরীক্ষা ও ক্লাস করতে হয়।

স্কুল কর্তৃপক্ষ জানান, বিদ্যালয়ের আধা পাকা ভবনটি ১৯৫৭ সালে নির্মাণ করা হয়। এরপর আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। স্কুলটিতে প্লে গ্রুপ থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। শিক্ষার্থীর সংখ্যা মোটে ৫৫ জন। আর ক্লাসের মধ্যেই করানো হয় অ্যাসেম্বলি। চারজন শিক্ষক ও একজন অফিস সহকারী রয়েছেন। এর মধ্যে একজন শিক্ষক আবার দেড় বছর ধরে শিক্ষা প্রশিক্ষণে আছেন।

স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, ৫০ বছর ধরে এভাবেই চলছে এ স্কুল। নানা আশ্বাস-প্রতিশ্রুতিতেও বদলায়নি পরিস্থিতি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সময়ে সময়ে আসেন। পরিদর্শন করেন, চলে যান। কিন্তু স্কুলের ভঙ্গুর দশার কোনো উন্নতি হয় না।

এদিকে বিদ্যালয়ের এমন জরাজীর্ণ অবস্থার মধ্যেও গণমাধ্যমের সামনে কথা বলার সাহস করেননি শিক্ষক-শিক্ষিকারা। তবে অবকাঠামো নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকারের কাছে প্রবল আকুতি জানিয়েছে বিদ্যালয়টিতে অধ্যয়নরত কোমলমতি শিশুরা। এক রুমের মধ্যে দুই পাশে তিনটি করে বেঞ্চ বসানো। একসঙ্গে বসে ক্লাস করে দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। বারবার অভিযোগ জানিয়েও সমস্যার সুরাহা হচ্ছে না বলে জানান শিক্ষকরা। তারা বলছেন, বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীদের ওই পরিত্যক্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘরে বসেই পরীক্ষা ও ক্লাস করতে হয়।

স্কুল কর্তৃপক্ষ জানান, ক্লাসের মধ্যেই করানো হয় অ্যাসেম্বলি। তিনজন শিক্ষক ও একজন অফিস সহকারী রয়েছেন। স্কুলের এক অভিভাবক বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, ভালো স্কুলে পড়াতে পারি না। বাধ্য হয়েই এই স্কুলে দিয়েছি। কিন্তু বাচ্চাকে স্কুলে পাঠিয়ে ভয়ে থাকি। কখন জানি কি হয়ে যায়।’

স্কুলটির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, সরকারি স্কুল বলে আমার মেয়েকে এই স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলাম। কিন্তু কোনও সুযোগ-সুবিধাই নেই। ভর্তির পর থেকে নানান ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। ছোট্ট একটা রুমে সব ক্লাসের শিক্ষার্থীদের গাদাগাদি করে বসানো হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন, ‘এখন দেশের গ্রামের স্কুলগুলোতে নতুন নতুন ভবনসহ অবকাঠামোগত কত উন্নয়ন হচ্ছে। অথচ ৬৬ বছরেও এই স্কুলটির কোনো উন্নতি হলো না। এ জন্য কোনো অভিভাবক এখানে বাচ্চাদের দিতে চান না।’

স্কুলের প্রধান শিক্ষক রুমা চৌধুরী বলেন, ‘স্কুলটি উন্নতির জন্য আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অনেকবার আবেদন করেছি। নতুন ভবন নির্মাণের জন্য অনেক অফিসার এসে দেখেও গেছেন এবং প্ল্যান করেছেন, রিপোর্টও করেছেন, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। জায়গা না থাকায় কিছুই হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়েই এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে বাচ্চাদের পড়াতে হয়। আসলে আমরা তো সরকারি চাকরি করি। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।’ তিনি বলেন, ‘এটা সত্য, এখানে শিক্ষার নূন্যতম কোনো পরিবেশ নেই। তাই কোনো অভিভাবক তাদের বাচ্চাদের দিতে চান না। করোনার আগে এই বিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষার্থী ছিল। সেই সময় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আমাদের স্কুলে শিক্ষার্থীদের খাবার দিত। করোনার পরে শিক্ষার্থী কমে গিয়েছিল এখন আবার শিক্ষার্থী সংখ্যা দিন গেলেই বেড়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের জায়গা দিতে পারছি না। স্কুলটি যদি চার-পাঁচ তলা করে দিত তাহলে নিচ তলায় মাঠ করতে পারতাম আর বাকি তলায় ক্লাস ও অফিস রুম করতে পারতাম। ভবনটিতে এখন যেভাবে পলেস্টার খসে পড়ছে বর্তমানে আতঙ্কে আছি। কমিশনার ও মেয়রকে বলেছি বাচ্চাদের কোনো ক্ষতি হয়ে গিলে আমার কোনো দায় নেই।’

তিনি বলেন, ‘স্কুলটি সম্পর্কে আমি সবই জানি। পানি নেই, মাঠ নেই। মোটকথা বাচ্চাদের পড়াশোনার কোনো পরিবেশই নেই। তাই স্কুলটির উন্নয়নে বারবার প্রস্তাব দিয়েছি সবার একই কথা করে দিচ্ছি করে দিচ্ছি কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই।’

এ বিষয়ে ৪১ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সারোয়ার হোসেন আলো জানান, মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৫০-৬০ বছরের পুরনো। স্কুলটি বাতিল করার পরিকল্পনা হয়েছিল। আমি তা হতে দেইনি। এই সরকারের আমলে স্কুল বিলুপ্তির বিষয়টা বেমানান। তবে এর অবকাঠামোগত উন্নয়ন জরুরি।

সূত্রাপুর থানা শিক্ষা অফিসার মির্জা নুরুন্নাহারের সাথে একাধিকবার এ বিষয়ে যোগাযোগ করার চেষ্ঠা কার হলেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৮/১১/২০২৩  

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়