ফারদিন ফেরদৌসঃ শিক্ষা নিয়ে এত কাটাছেঁড়া ও গবেষণা সম্ভবত বিশ্বের আর কোথাও হয় না। গেল দুই দশক ধরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে যে, এখন পর্যন্ত তা স্থিতিশীলতায় আসেনি। প্রাইমারিতে বার্ষিক পরীক্ষা না রেখে বছরজুড়ে মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে জিপিএ-৫ পদ্ধতি তুলে দিয়ে চালু করা হচ্ছে পারফরম্যান্স ‘ইনডিকেটর’, অর্থাৎ বিশেষ পারদর্শিতার ‘চিহ্ন’। পিরামিড বা ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভূজকে মূল্যায়ন চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করা হবে। ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের দিয়ে এ প্রক্রিয়ায় মূল্যায়ন শুরু হবে। অথচ গ্রেডিং পদ্ধতিই এখন পর্যন্ত বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত সিস্টেম। ব্যাপারটি অভিভাবক ও শিক্ষাবিদ কারোরই তেমন পছন্দ নয়।
তার ওপর শিক্ষা সংশ্লিষ্টদেরকে নানা বঞ্চনার মধ্যে রেখে দিয়ে ওই অস্থিতিশীলতার গোড়াতেই জল ঢেলে যাচ্ছে দেশের সরকার। এখন পর্যন্ত কোনো সরকারই শিক্ষা বাজেটে আশানুরূপ বরাদ্দ দেয়নি। বৈষম্য নিরসনে প্রায়ই বাংলাদেশের শিক্ষকসমাজকে আন্দোলনে নামতে হয়। কখনো প্রাথমিক, কখনো মাধ্যমিক; এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও অধিকার আদায়ে আন্দোলনে যেতে হয়।
রাষ্ট্রীয় ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন স্কেল অনুযায়ী সম্মান দেয়া হয়নি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকদের অবস্থান ১৯তম সমবেতনের সচিবদের অবস্থান ১৬তম। এমনকি উপাচার্যদের ১৭তম অবস্থানে রাখা হয়েছে। জনগণের করের টাকায় প্রাপ্ত একই বেতনের একজনের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা বেশি, অন্যজনের কম বলে যথার্থ বেতনকাঠামো নির্ধারণ করে, ওই সাপেক্ষে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী শিক্ষকদের মর্যাদা নিশ্চিত করার দাবি ওঠে ২০১৫ সালে। ওই দাবি পর্যন্তই সই, শিক্ষকের মর্যাদা বেড়েছে এমনটা আমরা শুনিনি।
এমন এক বাস্তবতায় ক্যাডার বৈষম্য নিরসনে আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। ক্যাডার-বৈষম্য ও পদোন্নতি সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানসহ বিভিন্ন দাবিতে ০২ অক্টোবর (সোমবার) সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির ডাকে দেশের সরকারি কলেজ, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), শিক্ষা বোর্ডসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে এই কর্মবিরতি পালন করা হয়। ফলে এসব দপ্তর ও সরকারি কলেজগুলোয় নিয়মিত ক্লাস বা কাজ হয়নি। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির নেতারা ঘোষণা দিয়েছেন, দাবি পূরণ না হলে ১০, ১১ ও ১২ অক্টোবরও সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করা হবে।
আন্দোলনরত বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) শাহেদুল খবীর চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেছেন, শিক্ষা ক্যাডারের অস্তিত্ব এখন বিপন্ন হওয়ার পথে। যথাযথ কর্তৃপক্ষকেও এসব সমস্যা জানানো হয়েছে। সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে সহযোগী অধ্যাপক হয়েছেন শিক্ষা ক্যাডারের ৬৯০ জন কর্মকর্তা। দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর এ পদোন্নতিও প্রত্যাশা পূরণ করেনি। অনেকেই এখনো পদোন্নতি বঞ্চিত রয়ে গেছেন।
মায়া, প্রেম, ঔদার্য, সমতা, ইতিবাচক চিন্তা, বিজ্ঞানমনষ্ক যুক্তিবাদী ধ্যান ধারণা ও মুক্তচিন্তায় একজন শিক্ষকের গড়ে তোলার কথা কর্মঠ, দেশপ্রেমিক, মানবিক, অসাম্প্রদায়িক ও পরমতসহিষ্ণু ভবিষ্যৎ নাগরিক। কিন্তু শিক্ষককেই যখন তার নিজের নানামুখী বঞ্চনা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়; তার কাছ থেকে যুক্তি ও বুদ্ধির আনন্দআলোক স্বতঃস্ফূর্ততায় আসে না।
আমরা যতদিন না শিক্ষককে সর্বোচ্চ মর্যাদায় আসীন করছি ততদিন প্রজ্ঞাবানরা শিক্ষকতা পেশায় আসবে না। শিক্ষিত জাতি গঠনের স্বপ্নও কোনদিন পূর্ণ হবে না। গুণগত শিক্ষা চাইলে শিক্ষকের মর্যাদা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
চীন, ভারত বা ঘানায় এখনো পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের শিক্ষক হতে উৎসাহিত করে। অন্যদিকে ইসরায়েল বা ব্রিটেনে বাবা-মায়েরা চান না তাদের সন্তানরা শিক্ষকতায় ঢুকুক। বিশেষ করে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান বা মালয়েশিয়ায় শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অনেক ওপরে। কার্যত আন্তর্জাতিকভাবে যেসব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা হয়, সেখানে ওই দেশের ছাত্র-ছাত্রীরাই সবচেয়ে এগিয়ে থাকে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, মর্যাদা রয়েছে বলে ভালো শিক্ষক পাওয়া এবং ধরে রাখাও সহজ হয় এসব দেশে।
ব্রিটেনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক এবং সোশ্যাল রিসার্চ ২০১৮ সালে ৩৫টি দেশে ৩৫,০০০ মানুষের ওপর এক গবেষণা চালিয়ে ‘শিক্ষক মর্যাদা সূচক’ প্রকাশ করে। ওই গবেষণায় উঠে আসে বিশ্বে চীনের শিক্ষকরাই সবচেয়ে বেশি মর্যাদা পান।
রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও সামাজিক মানসম্মান প্রাপ্যতার দিক দিয়ে ১০টি শীর্ষ দেশের তালিকায় চীন, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, ভারত, নিউজিল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের নাম উঠে আসে। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতেও শিক্ষকের মর্যাদা সারা বিশ্বে অষ্টম। আর আমরা কোন তলানিতে পড়ে আছি তার হিসেব মেলা ভার। ওই গবেষণা রিপোর্টে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্ক এ তিনটি মুসলিম দেশও রয়েছে। যাদের ধারেকাছে জাপান, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইসরায়েল বা ইংল্যান্ডও নেই।
ক্লাসরুমে শিক্ষক হিসেবে সম্মান ও মর্যাদায় চীন তালিকার সবচেয়ে ওপরে। চীনের ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্বাস করে শিক্ষকদের সম্মান করতে হবে, যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে এ গড় মাত্র ৩৫ শতাংশ।
ভার্কি ফাউন্ডেশন নামে যে দাতব্য প্রতিষ্ঠানটি ওই গবেষণায় পয়সা জুগিয়েছে, সেটির প্রতিষ্ঠাতা সানি ভার্কি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এ গবেষণায় একটি প্রচলিত বিশ্বাস প্রমাণিত হলো যে যেসব সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা বেশি, সেখানে শিক্ষার্থীরা ভালো শিক্ষা পায়। কোনো সন্দেহ ছাড়াই আমরা এখন বলতে পারি, শিক্ষককে মর্যাদা করা কোনো নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং এটা কোনো দেশের শিক্ষার মানের জন্য অতি জরুরি।’
আমরা কবি কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতাটি স্মরণ করতে পারি। দিল্লির বাদশাহ আলমগীরের পুত্র শিক্ষাগুরুর চরণে পানি ঢালছে, কিন্তু নিজ হাতে চরণ ধুয়ে দেয়নি বলে বাদশাহ বেশ কষ্ট পান। পুত্রকে শিক্ষকের মর্যাদার যথার্থ আদব শেখাতে বললেন ওই শিক্ষককে। অতঃপর শিক্ষক উচ্ছ্বাসভরে বললেন, ‘আজ হতে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির/ সত্যিই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’ আমাদের রাজনীতিবিদরা যতদিন না বাদশাহ আলমগীরের আদবকেতা রপ্ত করতে পারছে, ততদিন এভাবেই বৈষম্য নিরসনে আন্দোলন করে যেতে হবে।
শিক্ষকের মর্যাদায় শীর্ষ দশে নেই এমন দেশ জাপানেও শিক্ষকদের দেখলে পুরো সমাজ তার সম্মানে দাঁড়িয়ে কুর্ণিশ করে। যানবাহনে সবার আগে আসন বরাদ্দ করে। কোনো রাষ্ট্রীয় সেবাগ্রহীতা হিসেবে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করতে দেয়া হয় না। সেই জাপানি প্রবাদ বলছে, ‘একজন মহান শিক্ষকের সঙ্গে একটি দিন হাজার দিনের আনন্দদায়ক অধ্যয়নের চেয়ে উত্তম।’ একজন আদর্শ শিক্ষাগুরুর সান্নিধ্য ও সদিচ্ছার প্রভাব শিক্ষার্থীর জীবনে অসীম ও সুদূরপ্রসারী। সেই শিক্ষক যদি মনোযোগের তালিকায় অগ্রগণ্য না থাকেন কোনো ভালো ফল আশা করা বৃথা।
কাজেই আমরা সজ্ঞানে ও সচেতনভাবে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন, পদোন্নতি ও যথাযথ মর্যাদা প্রদানসহ বিভিন্ন দাবিতে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারদের আন্দোলনকে সমর্থন করছি।
ক্যাডারের তারতম্যে বড় ছোট নামের মান্ধাতা আমলের প্রথা আমরা কেন জিইয়ে রাখব? সামগ্রিকভাবে বঞ্চিত চিকিৎসা, কৃষি, পুলিশসহ অন্যান্য ক্যাডারের বৈষম্যও আশু নিরসন জরুরি। আপন যোগ্যতাবলে রাষ্ট্রের যারা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে থাকবেন, দেশের সন্তানদের যারা পড়াশোনা করিয়ে মানুষ করে গড়ে তুলবেন, তাদেরকে বঞ্চিত রেখে সুশাসন ও সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা যাবে না।
শিক্ষকের প্রাপ্য মর্যাদা দূরে থাক, এখানে আজকাল শিক্ষকরা মার খান, লাঞ্ছিত হন, নিগ্রহের শিকার হন। ঠুনকো অজুহাতে শিক্ষকদেরকে অযথা জেল খাটানোর ঘটনাও বিস্তর। আমরা স্মরণ করতে পারি মুন্সীগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হূদয় চন্দ্র মণ্ডলের কথা। যাকে গত বছর কথিত ধর্মাবমাননার অভিযোগ এনে জেল খাটানোর পর অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পের প্রোটাগনিস্ট আইন পাস করা শশীভূষণের অগণন দুর্গতিটা যেন আমাদের শিক্ষকসমাজে না নামে। তাদের ‘স্বাভাবিক জীবন’ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধানতম কর্তব্য। কর্মযোগী মানুষ তৈরি আর মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধনে দায়িত্ব নিয়ে আমাদের এ রাষ্ট্রকেই নিবিষ্ট হতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৪/১০/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়