।। হাসি ইকবাল।।
শিক্ষা মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম একটি। শিক্ষার আবেদন মানবিক এবং শিক্ষা হতে হবে সবার জন্য উন্মুক্ত। বলার অপেক্ষা রাখে না শিক্ষা কোনো সুযোগ নয়, শিক্ষা হলো সবার অধিকার। যদিও একটি দরিদ্র দেশ হিসেবে শিক্ষা এখনো অধিকারে আসেনি, তা মৌলিক চাহিদার মধ্যেই রয়ে গেছে। কিন্তু দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সবার আগে প্রয়োজন একটি সুসমন্বিত শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা।
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে শিক্ষার সার্বিক কল্যাণে রাষ্ট্রকেই এর দায়-দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ অশিক্ষা কিংবা ভুল শিক্ষায় শিক্ষিত কোনো জাতি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। অনেকে মনে করছেন শিক্ষা নিম্নমানের হওয়ার পেছনে শিক্ষকদের শিক্ষার প্রতি অনীহা, যা সৃষ্টি হয়েছে মূলত শিক্ষকদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দাবিসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না করার কারণে। এছাড়া বর্তমান শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যবসার দিকটাও লক্ষ করা যায়- যেমন প্রাইভেট পড়ানো, টিউশনি, কোচিং ইত্যাদি কারণে শিক্ষকদের ক্লাসরুমে পাঠদানে অনীহা দেখা যায়।
শিক্ষা রাষ্ট্রের নাগরিকদের শুধু মৌলিক অধিকারই নয়, এর সঙ্গে জাতির ভবিষ্যৎও জড়িত। নানা ধরনের অরাজকতা, বিশৃঙ্খলার কারণে রাষ্ট্রের বৈধ নাগরিকরা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে আজ বঞ্চিত। দেশে যখন সমরাস্ত্র খাতে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে তখন শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হচ্ছে নামমাত্র। যদিও একটি শিক্ষিত ও কর্মঠ জাতি গঠনের লক্ষ্যে ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও আমাদের শিক্ষা খাতে এখনো অনেক ক্ষেত্রে রয়ে গেছে অসঙ্গতি। দেশে অনেক স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়েও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বলা চলে শিক্ষার অবারিত সুযোগ এখন সবার হাতের নাগালে; কিন্তু তারপরও শিক্ষার বেহাল অবস্থা কেন?
শিক্ষায় এখন রাষ্ট্রীয় মনোযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাকে যুগোপযোগী ও আধুনিক শিক্ষার দিকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। যুক্ত হচ্ছে সৃজনশীল পদ্ধতি, গ্রেড পদ্ধতি। সেই সঙ্গে ফলাফলও আশানুরূপ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক ছাত্রছাত্রীদের হাতে পেঁৗঁছে দেয়া হচ্ছে বছরের প্রথম দিনেই। যা কিনা বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একটি অন্যতম বড় অর্জন।
কিন্তু শিক্ষাকে একটা পর্যায় পর্যন্ত অবৈতনিক ও শিক্ষার প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও প্রকৃত শিক্ষার গুণগত পরিবর্তন তেমনভাবে সাধিত হয়নি। বরং আর্থ-সামাজিক কারণে আমাদের দেশের অনেক শিশুই প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পার হতে পারে না। এক পরিসংখ্যান মতে, আমাদের দেশে স্কুলের বাইরে থাকা শিশুদের হার ভারত ও শ্রীলঙ্কার চেয়েও বেশি। যদিও এ সংখ্যা পাকিস্তানের চেয়ে কম।
আমাদের সংবিধানে শিক্ষাকে একটি বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। এ অনুচ্ছেদ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ভাগে অন্তর্ভুক্ত। যাতে তিনটি বিষয় উল্লেখ আছে। প্রথমত, এখানে আইনানুযায়ী সর্বজনীন, গণমুখী, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার কথা বলা আছে। সংবিধান বলছে, রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করবে।
একই সঙ্গে সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য এবং সে প্রয়োজন পূরণের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির ব্যবস্থাও করবে। তৃতীয় বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা হবে। আন্তর্জাতিক আইন ও নীতি অনুযায়ী শিক্ষা একটি অধিকার। কিন্তু আমাদের সংবিধান শিক্ষাকে অধিকারের মর্যাদা দেয়নি।
নানা ধরনের অরাজকতা, বিশৃঙ্খলার কারণে রাষ্ট্রের বৈধ নাগরিকরা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নানারকম উদ্যোগ অতীতে নেয়া হয়েছে, এমনকি বর্তমান সরকারের শিক্ষা খাতের সার্বিক উন্নয়নও প্রশংসাযোগ্য; কিন্তু তারপরও শিক্ষার মান নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অভাব নেই। উৎকণ্ঠার প্রধান কারণ শিক্ষার হার বাড়ছে; কিন্তু ঝরে পড়ার হার কমছে না।
দেশের স্কুলগুলোতে শিক্ষা ও শিক্ষকদের মানোন্নয়নের বিষয়ে জরিপ করে আমার অধিকার ফাউন্ডেশন যে মতামত দিয়েছে তাতে এ ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন শিশির শীল বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখেছি, শিক্ষকদের মান খুবই নিম্ন পর্যায়ের। সেখানে শিশুরা যে মানসম্মত শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠছে না এটা বুঝতে কষ্ট হয় না। ফলে সরকারের সব উদ্যোগ তৃণমূলে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই শিক্ষাকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া যেমন জরুরি তেমনি শিক্ষা প্রদানের মান নিয়ন্ত্রণও সমানভাবে জরুরি।
মূলত শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে যে আশঙ্কাজনক অধঃপতন হয়েছে তার জন্য সামগ্রিক ব্যবস্থাটাই দায়ী। স্কুল-কলেজে যথাযথ শিক্ষা না দেয়া, পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বিষয়ে পড়াশোনা কমে যাওয়া, স্বল্প পরিশ্রমে সফল হওয়ার প্রবণতা, কোচিং, প্রাইভেটের ওপর নির্ভর হওয়া, বাড়িয়ে নম্বর দিয়ে কৃত্রিমভাবে মেধার বিকাশ ঘটানো- এসব কিছুর সম্মিলিত ফলাফল হচ্ছে শিক্ষার মান না বেড়ে বরং বিপর্যয় নেমে আসা। যার ফলস্বরূপ দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব গ্রাস করছে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে।
অতীতে কয়েকটি বাজেটে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। শিক্ষা খাতের সার্বিক উন্নয়নে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকালের মেয়াদ এবং শ্রেণিবিন্যাস, প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে শিশুর ন্যূনতম বয়স, বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে দায়িত্ব, বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশনের ওপর অর্পণসহ গৃহীত অন্যান্য উদ্যোগ যথাযথভাবে প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে শিক্ষা খাতের সার্বিক চিত্র পাল্টে যেতে হয়তো সময় লাগবে না। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে।
শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য মানুষের চরিত্র গঠন করা, আদর্শ ও সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলা। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই যখন দুর্নীতিগ্রস্ত তখন আর সেখান থেকে ভালো কী আশা করা যেতে পারে। যে শিক্ষা সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে সেটাই হলো প্রকৃত শিক্ষা। এক মতবিনিময় সভায় অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল তিনটি বিষয়কে শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ভিত্তিগুলো হলো- শিক্ষক, বই এবং পরীক্ষা। তিনি আরো বলেন, পাঠ্যবই সহজভাবে লেখা উচিত, যাতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা নিজে নিজে পড়ে বুঝতে পারে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের প্রশ্নের মান ভালো থাকে না, ভুল থাকে। ছবিগুলো থাকে অস্পষ্ট। তাছাড়া পরীক্ষা পদ্ধতিটা প্রশ্নবিদ্ধ বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এমসিকিউ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এমসিকিউ তুলে নেয়া উচিত, এর কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। এ সময় শিক্ষাবিদ ড. ফরাস উদ্দিন বলেন, কারিকুলাম ভারী হয়ে গেছে। দেখা গেছে নবম শ্রেণির পড়া, একাদশে আবার অনার্সেও পড়ানো হচ্ছে।
এতে এক পড়া তিন-চার জায়গায় পড়ানো হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, বেসিক বিষয়গুলো যুক্ত করে বাড়তি বিষয় বাদ দেয়া উচিত। বাড়তি বিষয় শেখানোর জন্য আইসিটিতে আমাদের অনেক উন্নতি হয়েছে, এর জন্য বই ভারী করার কোনো অর্থ হয় না।
লেখক:
হাসি ইকবাল : কবি ও নাট্যকার।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৮/১১/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়