চবি: ‘শিক্ষকদের দ্বন্দ্বের বলি’ শিক্ষার্থীরা

ইনস্টিটিউট অফ মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ বিভাগ

চট্টগ্রামঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ইনস্টিটিউট অফ মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের গবেষণা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় নতুন অ্যাকাডেমিক ভবন। গত ৪ জুন ভবনটি উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।

চবি মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদের আওতাভুক্ত একটি ইনস্টিটিউট ও দুইটি বিভাগ ওই ভবনে স্থানান্তর করা হয়। সেগুলো হলো ইনস্টিটিউট অফ মেরিন সায়েন্সেস এবং ওশানোগ্রাফি ও ফিশারিজ বিভাগ।

শিক্ষার্থীরা জানান, নতুন ভবনের কর্তৃত্ব ও বিভাগগুলোর কক্ষ বণ্টন নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। আর এ দ্বন্দ্বের কারণে ওশানোগ্রাফি বিভাগের শিক্ষার্থীরা ল্যাব সুবিধা পাচ্ছেন না।

অন্যদিকে বিভাগ দুটির নেই ল্যাবরেটরি ও সেমিনার-লাইব্রেরি। রয়েছে লোকবল সংকট। এতদিন মেরিন সায়েন্সেসের ল্যাব ও সেমিনার-লাইব্রেরি ব্যবহার করা গেলেও নতুন ভবনে আসার পর থেকে তারা আর সেই সুযোগ পাচ্ছেন না। এতে করে ভুক্তভোগী হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

ডিন ও শিক্ষকদের সমন্বয়ে ২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়, মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদের অন্তর্ভুক্ত ওশানোগ্রাফি ও ফিশারিজ বিভাগ পুরোপুরি চালু না হওয়া পর্যন্ত মিউজিয়াম, কক্সবাজারে অবস্থিত ফিল্ড স্টেশন, সেমিনার-লাইব্রেরি, ইনস্টিটিউট অফ মেরিন সায়েন্সেসের ল্যাবগুলো (সুযোগ সুবিধা ও লোকবলসহ) এই দুই বিভাগ ব্যবহার করতে পারবে।

ইনস্টিটিউট অফ মেরিন সায়েন্সেস কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, বিভাগগুলোকে সূচনালগ্ন থেকেই সহযোগিতা করা হচ্ছে। বর্তমানে সেশনজট ও নিজ ইনস্টিটিউটের স্বার্থ বিবেচনা করে পরিকল্পনা ও অ্যাকাডেমিক কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে অপর দুই বিভাগকে আর সাহায্য না করার।

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের অভিমত, শিক্ষার্থীরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে সব শিক্ষককে নজর দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে যাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, অনুষদের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো ইনস্টিটিউট অফ মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ, যেটি প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৭১ সালে। এ অনুষদের অধীনে ২০১৮ সালে ওশানোগ্রাফি ও ফিশারিজ নামের দুইটি স্বতন্ত্র বিভাগ চালু করা হয়।

ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস থেকে কয়েকজন শিক্ষক এই বিভাগগুলোর শিক্ষক হিসেবে স্থানান্তরিত হয়। নতুন দুটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা হলেও এই দুই বিভাগকে ইনস্টিটিউট অফ মেরিন সায়েন্সেসের সহযোগিতা নিতে হতো।

নতুন ভবনের জন্য ২০১৪ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) দেয় ইনস্টিটিউট অফ মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ। ২০১৭ সালে প্রকল্পটি একনেকে পাস হয়।

‘চবি ইনস্টিটিউট অফ মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের গবেষণা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রকল্পের জন্য ৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। পাঁচ তলাবিশিষ্ট অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ভবনটি গত ৪ জুন শিক্ষামন্ত্রী উদ্বোধনের পর চালু হয়।

তবে মূল জটিলতা শুরু হয় ভবনের কর্তৃত্ব ও শিক্ষকদের রুম বণ্টন নিয়ে। প্ল্যানিং ও ডেভেলপমেন্ট কমিটির সভা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নবনির্মিত অ্যাকাডেমিক ভবনের নিচ তলা অনুষদ কার্যালয়ের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। অনুষদ কার্যালয়ের আওতায় কনফারেন্স রুম, মিউজিয়াম, এবাদতখানা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যান্টিনসহ সব কক্ষ ও সুবিধাগুলো ডিনের তত্ত্বাবধানে থাকবে।

দোতলায় মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউট, তৃতীয় তলায় ওশানোগ্রাফি বিভাগ এবং চতুর্থ তলা ফিশারিজ বিভাগের জন্য নির্ধারণ করা হয়। পঞ্চম তলায় ক্রমানুসারে মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটকে চারটি কক্ষ, ওশানোগ্রাফি বিভাগকে দুটি কক্ষ ও ফিশারিজ বিভাগকে দুটি করে শ্রেণিকক্ষ বরাদ্দ দেয়া হয়।

নতুন শিক্ষক ভবনে প্রথম ১৭টি কক্ষ মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের, পরের ৯টি কক্ষ ওশানোগ্রাফি বিভাগের ও শেষের ৯টি রুম ফিশারিজ বিভাগের শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়।

মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের দাবি, ভবনটি দেয়া হয়েছে শুধু মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটকে। এ নিয়ে মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের সঙ্গে অপর দুই বিভাগের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। কক্ষে তালা দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। বিষয়টি রিভিউ করার জন্য সিন্ডিকেটে তোলা হলে সিন্ডিকেট আগের সিদ্ধান্তই বহাল রাখে।

ওশানোগ্রাফি বিভাগের শিক্ষার্থী জানান, অতি সম্প্রতি স্নাতক চতুর্থ বর্ষের টার্ম পেপার জমা নিয়ে জটিলতায় পড়েন বিভাগের তিন শিক্ষার্থী। টার্ম পেপারের জন্য ল্যাব ব্যবহার প্রয়োজন হলে তাদের অনুমতি দেয়নি মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউট। এ জন্য পরপর দুইবার চিঠি দিলেও মেরিন সায়েন্সেন্স ইনস্টিটিউট থেকে না করে দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ল্যাব সেটিং হয়নি বলে কারণ উল্লেখ করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা ভেবেছি নতুন ভবনে আসলে আমরা আরও সুবিধা পাব, সব সীমাবদ্ধতা কেটে যাবে। এখন দেখছি আমরাই ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছি।’

এ বিষয়ে মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. শেখ আফতাব উদ্দিন জানান, ২০১৮ সালে বিভাগ দুটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ছয় বছর ধরে ওশানোগ্রাফি ও ফিশারিজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের নিয়মিত সুবিধা দিয়ে আসছিলেন তারা। টানা ছয় বছর সুবিধা দেয়ার পর এখন তারা প্ল্যানিং ও অ্যাকাডেমিক কমিটিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারা নিজ বিভাগ ছাড়া অন্য বিভাগগুলোকে কোনো সহযোগিতা করতে পারবেন না। এই সিদ্ধান্ত তারা প্রশাসন বরাবর পাঠিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীদের জটের কথা চিন্তা করেছি। আমাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা তাদের (ওশানগ্রাফি ও ফিশারিজ) থেকে বেশি। একটি ল্যাব, সেমিনার-লাইব্রেরি তিনটা বিভাগ মিলে ব্যবহার করলে পরীক্ষাসহ অ্যাকাডেমিক কাজে সমস্যা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের ল্যাবও যেমন, তাদের দুই বিভাগকে ওই রকম দুটো ল্যাব দেয়া হয়েছে। ছয় বছর ধরে তারা কি সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি? বিভাগ হিসেবে তাদেরও আলাদা বাজেট দেয়া হয়।’

শিক্ষকদের মধ্যকার মনোমালিন্য নিয়ে তিনি বলেন, ‘সেটা প্রাশাসন দেখছে। এখানে আমাদের এখতিয়ার নাই।’

প্রকল্পটি ইনস্টিটিউট অফ মেরিন সায়েন্সেসকে দেয়া হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

ওশানোগ্রাফি বিভাগের সভাপতি ড. মোহাম্মদ অহিদুল আলম ও ফিশারিজ বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রাশেদ-উন-নবী জানান, ২০১৯ সালে অনুষদের ডিন, পরিচালক, সভাপতি ও শিক্ষকদের এক সভায় সিদ্ধান্ত অনু্যায়ী তাদের এই সুবিধা (ল্যাব, সেমিনার) দিতে হবে। সেই সভায় বর্তমান মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও বর্তমান মেরিন সায়েন্সেস অনুষদের ডিনও উপস্থিত ছিলেন।

ওশানোগ্রাফি বিভাগের সভাপতি ড. মোহাম্মদ অহিদুল আলম বলেন, ‘শিক্ষকদের মধ্যে মনোমালিন্য থাকতে পারে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের কোনো দোষ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় হলো শিক্ষার্থীদের জন্য। ছাত্রদের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে ব্যঘাত ঘটাবে এমন কোনো সিদ্ধান্ত শিক্ষকরা নিতে পারেন না।’

ফিশারিজ বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রাশেদ-উন-নবী বলেন, ‘স্টাফদের থেকে শুনেছি তারা নাকি প্ল্যানিং কমিটিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমাদের কিছু ব্যবহার করতে দেবেন না। যদি প্ল্যানিংয়ের সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা প্রশাসনের কাছে যাব।’

তিনি বলেন, ‘উনারা যদি বলেন, ছয় বছর ধরে আমাদের সাহায্য করেছেন। ছয় বছরের মধ্যে দুই থেকে আড়াই বছর চলে গেছে করোনার জন্য। প্রশাসন থেকে আমাদের লোকবল দেয়া হচ্ছে না, প্রজেক্ট থেকে এখনও ইনস্ট্রুমেন্টস কেনা হয়নি।

‘ছয় বছর ধরে সাহায্য করছেন, তার মানে এই না যে এখনই সাহায্য করা বন্ধ করে দেবে।’

মনোমালিন্য নিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের নাম ইনস্টিটিউট অফ মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের গবেষণা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি। এখন আমি যদি দাবি করি এ ভবন ফিশারিজের, তাহলে কী হবে? ডিপিপি পাঠানোর সময় আমিও সেখানে যুক্ত ছিলাম। ডিপিপির অবজেক্টিভে তিন পক্ষকেই (মেরিন, ওশানোগ্রাফি, ফিশারিজ) অধিকার দেয়া হয়েছে।’

এ বিষয়ে মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামকে একাধিকবার কল করেও পাওয়া যায়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক বেনু কুমার দে বক্তব্যও পাওয়া যায়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কে এম নুর আহমদ বলেন, ‘উনাদের সবাইকে নিয়ে উপাচার্য মহোদয় সিন্ডিকেট মেম্বাররাসহ একটা বৈঠক করবেন। তখন এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০২/০৯/২০২৩    

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়