গার্মেন্টসকর্মী থেকে হলেন বিসিএস ক্যাডার

দিনাজপুরঃ জেলার বীরগঞ্জের মো. সইমুদ্দিন ও মোছা. তহমিনা বেগম দম্পতির বড় সন্তান মো. তমিজ উদ্দিন। সংসারে টানাপোড়নে পড়াশোনা ছেড়ে তাকে গার্মেন্টসে যোগ দিতে হয়। কিন্তু থেমে যাননি তমিজ। সব বাধা পেরিয়ে সবশেষ ৪১তম বিসিএসে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) তাকে শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করেছে।

তমিজ বলেন, ‘জীবনে দরিদ্রতার সঙ্গে সংগ্রাম করে আল্লাহর অশেষ রহমতে আজকে আমি ৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত। আল্লাহর অশেষ রহমত, বাবা-মায়ের দোয়া, শিক্ষক এবং কিছু ফেরেশতাতূল্য মানুষের সহযোগিতায় এত দূর আসা সম্ভব হয়েছে।’

দরিদ্র দিনমজুর বাবার সংসারে ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়ার একটা ভয়ে থাকতেন। কিন্তু ভালো ফলাফল, বৃত্তি ও স্কুলের শিক্ষকদের সহযোগিতায় এসএসসি পর্যন্ত তেমন সমস্যা হয়নি। ২০১৩ সালে মাধ্যমিক পাসের পর তার জীবনে নতুন করে সংগ্রাম শুরু হয়।

এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে গোল্ডেন ‘এ প্লাস’ পান। সাথে বৃত্তি। অর্থ সংকটে তাকে ভর্তি হতে হয় বাড়ির কাছে খানসামা ডিগ্রি কলেজে। ঠিক ওই সময়েই গ্রামের কিছু নেতার চাপে জমি-সংক্রান্ত বিরোধের জেরে তমিজের পরিবার বসতভিটা ছাড়তে বাধ্য হয়। এতে তার পড়ালেখার স্বপ্ন প্রায় শেষের পথে চলে যায়। তবুও স্বপ্নটাকে কিছুটা জিইয়ে রাখতে তমিজ কলেজে গিয়ে ‘বিজ্ঞান বিভাগ’ পরিবর্তন করে মানবিক বিভাগ নিয়ে সেই দিনই ঢাকায় চলে যান।

তমিজ বলেন, ‘২০১৩ সালের আগস্টে গার্মেন্টসে কাটিং সেকশনে কাজ নিই। সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা বা কোনোদিন রাত ৩টা পর্যন্ত কাজ। এভাবেই চলতে থাকে। আর সৃষ্টিকর্তার কাছে নালিশ করতাম, আমার ভাগ্যে যদি এটাই রেখেছ, তবে এসএসসিতে এত ভালো ফলাফল কেন?’

২০১৪ সালের নভেম্বরে কলেজের টেস্ট পরীক্ষার আগে সুযোগ বুঝে গার্মেন্টসের বসকে সব বলেন তমিজ। তিনি সব শুনে তমিজকে গ্রামে গিয়ে পরীক্ষা দিতে বলেন। তমিজ বলেন, ‘আমার চাকরি হারানোর ভয় ছিল। তাই তার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিই যে, আমাকে পরীক্ষার পরে আবার কাজে নিতে হবে। তিনি হেসে বলেন, “তোমার জন্য আমার দরজা সবসময় খোলা।” ভরসা পেয়ে ২০১৪ সালের অক্টোবরে টেস্ট পরীক্ষার এক মাস আগে গ্রামে চলে যাই। টেস্ট পরীক্ষার ফলাফলে আমি তৃতীয় হই। আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। বোর্ড পরীক্ষায় ‘এ প্লাস’ সহ আবারো বৃত্তি পাই।’

তিনি বলেন, ‘ভেবেছিলাম ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে আবার গার্মেন্টসে চলে যাব। কিন্তু আমার বন্ধু জাফর, বেলাল, গণির মাধ্যমে এসব কথা জানতে পেরে বোর্ড পরীক্ষা চলাকালীন আমার কাছে ছুটে আসেন ঠাকুরগাঁও সদরের সহকারী শিক্ষা অফিসার মো. মিলন ইসলাম স্যার, মো. সোহেল রানা ভাই, মো. এনাম ভাই। পরীক্ষার পর ওনারাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য সব ব্যবস্থা করে দেন। ২০১৫-১৬ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ভর্তির সুযোগ পাই। আমার শিক্ষক ও আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় ভর্তি হই।’

কঠিন সেই সময় যেন তমিজের চোখের সামনে। দৃশ্যের পর দৃশ্যে যেন তিনি নিজেকেই দেখছেন, নিজের লড়াইকে দেখছেন। আর বলে চলছেন, ‘শুরু হয় আমার টিউশন জীবন! ১টা থেকে ২টা, ২টা থেকে ৪টা টিউশনি করি! এভাবে পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনির টাকা দিয়ে চলি, বাসায়ও কিছু পাঠাই। এর পর আর আমাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে ২০১৯ সালে স্নাতক ও ২০২০ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন হয়। করোনাকালে বাড়ি গিয়ে নিষ্ক্রিয় না থেকে অনলাইনে টিউশনি চালিয়ে যাই। এর মধ্যে ৪১তম বিসিএস-এ আবেদন করি। এটাই আমার প্রথম বিসিএস ছিল।’

আবেদন তো হলো। আরও অনেকেই করেছেন আবেদন। তমিজ খুব ভালো করে জানেন এই সময়ে বিসিএস শিক্ষিত চাকরিপ্রার্থীদের কতটা আরাধ্য। ফলে আবেদন মানেই যে চাকরি নয়, তা তমিজ জানেন। সাথে এও জানেন বিসিএস ক্যাডার হতে হলে এক দীর্ঘ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু এর মাঝের সময়টা চলবে কী করে? ফলে আবার ঢাকায় তমিজ। কারণ, মাঝের এই সময়টার জন্য টিউশনিই যে শুধু ভরসা।

তমিজ বলছেন, ‘করোনার পর অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হলে ঢাকায় যাই। তখনো হল বন্ধ। মেসে থেকে সরাসরি টিউশনি শুরু করি। ওই সময় প্রায় দুপুর ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত টিউশনি করিয়েছি। বাকি সময়টুকু চাকরির প্রস্তুতি। ২০২১ সালের মার্চ মাসে ৪১তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নিই। উত্তীর্ণ হই। তারপর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ৪১তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা হয়। সেখানেও উত্তীর্ণ হই।’

এ পুরো সময়টায় তমিজ কিন্তু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন না। দারিদ্র্য, পরিবারের প্রতি দায়বোধ-এ সবই তাঁকে ছুটিয়ে বেড়িয়েছে। নিজের তৈরি পথে চলার জন্য হাত ধরে নিয়ে আসেন ছোট ভাইকে। তমিজের ভাষ্যে, ‘এ সময় ছোট ভাই রাজুকে ঢাকায় এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্য পড়াশোনায় সাহায্য করি। খরচ বেড়ে যায়। টিউশনিও বাড়াতে হয়। জমানো কিছু টাকা ছিল সেটাসহ বাড়ি থেকেও কিছু নিয়ে ওর জন্য খরচ করি। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়। পরিবারের সবার সিদ্ধান্তে তাকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি করাই। সে এখন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।’

জানা যায়, ৪৩ ও ৪৪তম বিসিএসের প্রিলিতে উত্তীর্ণ হন তমিজ। লিখিত পরীক্ষাও দেন। ৪৩-এর লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হন। ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিতেও উত্তীর্ণ হন। প্রাইমারি স্কুলে সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি হয় তমিজের। যোগ দেন চলতি বছরের জানুয়ারিতে, এখন সেখানেই শিক্ষকতা করছেন। এর পর চলতি বছরের জুনে ৪১তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন তমিজ। চূড়ান্ত ফলাফলে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন তিনি।

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/৩১/০৮/২০২৩    

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়