শিক্ষাবার্তা ডেস্কঃ এবারের অমর একুশে বইমেলায় বই প্রকাশ ও বিক্রির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসার আশঙ্কা করছেন প্রকাশক-লেখকরা। কাগজের দাম দ্বিগুণ এবং বই মুদ্রণের অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম প্রায় দেড়গুণের বেশি বেড়ে যাওয়ায় প্রকাশকরা অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার কম বই প্রকাশ করছেন। পা-ুলিপি প্রস্তুতির পরও প্রকাশ করতে পারছেন না অনেক লেখক। এসবের পাশাপাশি বইমেলার স্টলের জায়গার দাম ও নির্মাণ ব্যয় সংকুলান করতে না পেরে এবং প্রকাশনা ব্যবসায় মন্দার আশঙ্কায় মেলায় অংশ নিচ্ছে না অনেক প্রকাশনা সংস্থাও।
বইমেলার এমন চিত্র ভবিষ্যৎ শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন লেখক-প্রকাশকরা। তারা বলছেন, এমনিতেই গত দু’তিন বছর ধরে বই বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। তার ওপর এবার বই বিক্রি ও প্রকাশ কম হলে মনন ও সৃজনশীল লেখক-পাঠক তৈরিতে ও সৃজনশীল সাহিত্য বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।
এ ব্যাপারে লেখক, গবেষক ও শিক্ষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন দেশ রূপান্তরকে বলেন, কাগজের দাম বৃদ্ধির প্রভাব শুধু বইমেলা, নতুন বই প্রকাশ কিংবা পাঠক-লেখকের মনন-সৃজনশীলতায় পড়ে না; সামগ্রিকভাবে দেশ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ওপর পড়ে।
অবশ্য মেলায় মানসম্পন্ন ভালো বই প্রকাশের পক্ষে এই লেখক ও গবেষক। তিনি বলেন, বইমেলায় বই কম বের হোক, ভালো বই বের হোক। কম বই বের হলে খারাপ কিছু দেখি না। যদিও দাম বাড়বে, কিন্তু বই বিক্রি ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে মনে করি। কারণ গত দু’বছর লোকজন সেভাবে মেলায় আসতে পারেনি। এবার আশা করি, সেদিক থেকে এবার ভারসাম্য রক্ষা হতে পারে।
একইভাবে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি, একুশ বইমেলা স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক এবং পুঁথি নিলয় প্রকাশনা সংস্থার স্বত্বাধিকারী শ্যামল পাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বই বিক্রি ও বই প্রকাশের সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রভাব আমাদের সৃজনশীলতা মননশীলতায় পড়বে। সংস্কৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে মননশীল পাঠক ও লেখক তৈরি এবং নতুন সাহিত্য বিকাশ সবকিছু নিয়েই একটা সংকটের মধ্যে পড়ব আমরা।
এমন অবস্থায় আগামী ১ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলা শুরু হতে যাচ্ছে। বিকেল ৩টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশরীরে উপস্থিত থেকে মেলা উদ্বোধন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। উদ্বোধনের পরই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এবারের বইমেলার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘পড় বই গড় দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এখন চলছে প্রকাশকদের ব্যস্ত সময়। স্টল নির্মাণ ও সাজসজ্জায় রাতদিন কাজ চলছে। নির্ধারিত সময়ের আগে সব কাজ সম্পন্ন হবে বলে একাডেমির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বই প্রকাশ ও বিক্রি অর্ধেকে নেমে আসবে : শ্যামল পাল বলেন, বিলাসী লোকজন বই কেনে না, পাঠক বই কেনে। পাঠকের বই কেনার একটা বাজেট থাকে। অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে এবার সেই বাজেট কমবে। তার ওপর বইয়ের দাম বেড়েছে। ২০০ টাকার বই ৩০০ টাকা, ৪০০ টাকার বই ৬০০ টাকা হচ্ছে। তাতে বই বিক্রি কমে যাবে। আবার নতুন বই প্রকাশের সংখ্যাও এবার কমে যাবে। একটা বই বের করতে বিগত বছরগুলোতে যদি ৩০-৩৫ হাজার টাকা খরচ হতো, এবার সেটা ৬০-৭০ হাজার টাকা খরচ পড়বে। সেক্ষেত্রে প্রকাশকদেরও তো পুঁজির সংকট আছে।
নিজের প্রকাশনা সংস্থা থেকেও বই প্রকাশ কম হচ্ছে জানিয়ে এই প্রকাশক বলেন, এবার আমি ৫২-৫৫টা বই করছি। অথচ প্রতি বছর ১৩০-১৩৫টা বই করি। অর্থাৎ বই প্রকাশ ও বিক্রির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসবে এবার। বই প্রকাশ নিয়ে এবার তাড়াহুড়ো নেই। বই প্রকাশ করতে আগের বছরগুলোতে প্রকাশকদের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস ছিল, এবার সেটা নেই।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পরপর দুইবারের সাবেক সভাপতি এবং আকাশ প্রকাশনা সংস্থার স্বত্বাধিকারী আলমগীর সিকদার লোটন দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমরা সারা বছরই বই প্রকাশ করি। মেলায় গড়ে ২৫টির মতো বই বের হয়। এবার সেখানে ১৫টা প্রকাশ হতে পারে। কারণ কাগজের দাম চড়া। আবার চড়া দামেও প্রয়োজন অনুযায়ী কাগজ পাচ্ছি না।
প্রকাশনা সংস্থা ভাষাচিত্রের স্বত্বাধিকারী খন্দকার সোহেল বলেন, বইয়ের সংখ্যা এবার অবশ্যই কমে এসেছে। আমি নিজেও বইমেলায় ৭০-৮০টা বই করতাম, সেখানে এবার ২০টা বই করব কি না সন্দেহ আছে। পা-ুলিপি তৈরি আছে। কিন্তু সাহস পাই না। অসংখ্য প্রকাশক বই প্রকাশ কমিয়ে দিয়েছেন। গত বছর যে বইটার দাম ছিল ২০০ টাকা, সেটার দাম এবার হবে ৩৫০-৪০০ টাকা। স্বভাবতই এত টাকা দিয়ে এরকম চিকন একটা বই আমাদের পাঠককরা কিনবেন বলে মনে হয় না।
বেহুলা বাংলার প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী চন্দন চৌধুরী বলেন, প্রতি বছর আমরা শতাধিক বই করি। গত বছর করেছিলাম ১২৭টা বই। এইবার খুব বেশি হলে ৭০-৮০টা করব। অর্থাৎ ৪০ শতাংশ কমে যাবে। এটার কারণ কাগজের দাম বেড়েছে। প্লেট, বোর্ডসহ বইয়ের জন্য যে সব জিনিস লাগে, সেগুলোর দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। বছরজুড়ে বই প্রকাশনাতেও ভাটা পড়েছে। অর্ধেক হয়ে গেছে বই বিক্রি।
কাগজের দাম নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেই : অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, উন্নয়নের সঙ্গে সাংস্কৃতিক জিডিপি বৃদ্ধি করতে হবে। কিন্তু সেই সাংস্কৃতিক জিডিপির পেছনে সরকার তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সরকার এটাতে মনোযোগ দেয়নি। সংস্কৃতি বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছে সংস্কৃতির দ্বারা। সাংস্কৃতিক জিডিপি বৃদ্ধি একটা হতে পারত কাগজের মূল্য নিয়ন্ত্রণ অথবা সুলভ মূল্যে দেওয়া। সরকার যদি ঋণখেলাপিদের এত সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে, তাহলে সামান্য একটা বইমেলায় ৫ কোটি টাকা ভর্তুকি দিত, তা হলে কী হতো। এই জিনিসগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে দেখা উচিত ছিল। প্রকাশকদের বারবার আলাপ-আলোচনা করা উচিত ছিল। সংস্কৃতির প্রতি প্রধানমন্ত্রী সবসময় নমনীয়। তার কাছে তো জিনিসটা পৌঁছাতে হবে।
এ ব্যাপারে শ্যামল পাল বলেন, কাগজের দামটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমরা বারবার সরকারকে বলেছি, প্রতিযোগী কমিশনকে বলেছি, বিভিন্ন সংস্থাকে জানিয়েছি। দিকনির্দেশনা দিয়েছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি। কাগজ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তার ওপর বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে কাগজের দাম আরেক ধাপ, প্রায় ২০ শতাংশ দাম বেড়ে গেল।
মুদ্রণের সবকিছুর দাম বেড়েছে : মুদ্রণের সব কিছুর দাম বেড়েছে- জানিয়ে শ্যামল পাল বলেন, যে কালির দাম ছিল ১৬০০-১৮০০ টাকা সেট, সেই কালি হয়েছে ৪ হাজার টাকা সেট। প্লেটের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। মুদ্রণের জন্য যে সব জিনিস আমদানি করতে হয়, সেগুলোর সবকিছুর দাম বেড়েছে। প্রকাশক সোহেল খন্দকার বলেন, গত বছর যে বই পেস্টিং করেছি ৩০ টাকা দিয়ে, এবার তাকে দিতে হচ্ছে ৫০ টাকা। প্লেটেও সমহারে বেড়েছে। কালি ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধির কারণে প্রিন্টিং রেট বেড়েছে। ছাপানো খরচ যেটা ছিল ৩০০ টাকা, সেটাতে ৫০ টাকা বেড়েছে। অন্যগুলো এক-তৃতীয়াংশ থেকে এক-চতুর্থাংশ বেড়েছে। বাঁধাইয়ের বোর্ড কাগজ ও কাপড়েরও দাম বেড়েছে।
অনেক প্রকাশক অংশ নিচ্ছেন না: আকাশ প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী আলমগীর সিকদার লোটন বলেন, বাংলাবাজারের অনেক নামকরা প্রকাশক এবার মেলায় যাচ্ছেন না। এর মধ্যে একটি আছে যারা বাম রাজনীতির বই বের করেন। আবার রাজনীতিসহ মূলধারার বই বের করেন এমন কিছু প্রকাশকও স্টল নেননি। কাগজের দাম তো বেড়েছেই। তার ওপর স্টলের জায়গার দাম বেশি হয়েছে। স্টল বানাতে যেসব জিনিসপত্র লাগবে সেগুলোর দামও বেড়েছে।
ভাষাচিত্রের স্বত্বাধিকারী খন্দকার সোহেল বলেন, ৫-১০ বছর আগে প্রকাশকরা বইমেলায় স্টল নিলে, তাদের পরবর্তী ছয় মাস আর কিছু করতে হতো না, তাদের এত লাভ হতো। কিন্তু এবার অন্তত ১০০ প্রকাশক বইমেলায় স্টল নিচ্ছেন না। এটা গত দুই বছর ধরেই হচ্ছে। কারণ বইমেলায় স্টল নিলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। অর্থাৎ প্রকাশনা সংস্থাগুলো বইমেলা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
তবুও বইমেলা: গত দু’বছরও করোনার কারণে প্রকাশনা ব্যবসা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকাশকরা। তারা বলেছেন, তারপরও চেতনার জায়গা থেকে তারা বইমেলায় অংশ নিয়েছেন এবং এবারও নিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে আলমগীর সিকদার লোটন দেশ রূপান্তরকে বলেন, মেলা থেমে থাকবে না। একুশের মেলা বাঙালির একটা চেতনার জায়গা। তারা মেলায় যাবেন। কিন্তু বই অতটা কিনতে পারবেন না। কারণ মানুষের পকেটে টাকা নেই। সে হিসেবে বই বিক্রি কমে যাবে।
প্রকাশক খন্দকার সোহেল বলেন, এবারের বইমেলা নিয়ে এখনো আমরা দোদুল্যমানতায় আছি। একই সঙ্গে আশাবাদী, আবার উদ্বেগেও আছি। আশাবাদী এই কারণে যে, এবারের বইমেলার করোনার কোনো প্রভাব নেই, যেটা গত দুই বছর ছিল। মেলার সময় ও স্টল বিন্যাস নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। এবার মেলায় প্রচুর লোক আসবে। এইবারের মেলার ডিজাইনটা সুন্দর হয়েছে। কিন্তু শঙ্কার জায়গা হলো নতুন বই বিক্রি নিয়ে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০১/৩১/২৩