শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ দেশের বেসরকারি স্কুল-কলেজ পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা রাখে পরিচালনা পর্ষদ। আর বিদ্যমান পরিচালনা পর্ষদের প্রবিধানমালা অনুযায়ী ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডির ১৬টি দায়িত্ব পালনে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু গভর্নিং বডির সভাপতি এসব দায়িত্বের বাইরে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অযাচিত হস্তক্ষেপ করেন। যাতে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন অধ্যক্ষ/ প্রধান শিক্ষক। নামি স্কুলের ক্ষেত্রেই এমনটি হয়ে থাকে।
এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মূল বেতন, উত্সব ভাতা, অবকাঠামো নির্মাণসহ প্রায় সব অর্থই ব্যয় করে সরকার। এক সময় বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা সরকারের কাছ থেকে কোনো বেতন পেতেন না। পরবর্তী সময়ে এমপিওভুক্তির মাধ্যমে তারা ৪০ বা ৫০ শতাংশ বেতন সরকার থেকে পাওয়া শুরু করেন। ২০০৪ সাল থেকে শতভাগ বেতন দিচ্ছে সরকার।
গভর্নিং বডি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় এতটাই অযাচিত হস্তক্ষেপ করছে তাতে মনে হচ্ছে, প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সরকারের কোনো ভূমিকাই নেই। সবই করে গভর্নিং বডি। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। নামি প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গভর্নিং বডির কোনো ভূমিকা নেই। প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ, কেনাকাটার দিকেই নজর, যার মাধ্যমে গভর্নিং বডির সভাপতি-সদস্যরা আর্থিকভাবে লাভবান হন।
রাজধানীর আইডিয়াল স্কুলে গভর্নিং বডির সদস্যরা নানা অনিয়ম ও অনৈতিক কাজে জড়িয়েছেন। গভর্নিং বডির সদস্য গোলাম আশরাফ তালুকদারের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার চার্জশিট রয়েছে। পুলিশ এখন তাকে খুঁজছে। আরেক সদস্য মুসতাক আহমেদ একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীকে বিয়ে করে সমালোচনার মুখে পড়েছেন। ছাত্রী বিয়ে করার এই কাজকে অনৈতিক বলেছে আদালত এবং একই সঙ্গে মুসতাক আহমদকে স্কুলে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আরেক সদস্য মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু অনেক আগেই খুন রয়েছেন।
ভিকারুননিসা নূন স্কুলের গভর্নিং বডির সদস্য শিক্ষক প্রতিনিধি ফারহানার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। দুর্নীতি দমন কমিশনেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে। মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নিয়মিত কমিটির সদস্যরা ছয় বছরে ১ কোটি ৫৪ লাখ ৯৬৪ টাকা সম্মানি নিয়েছেন। কয়েক মাস আগে গভর্নিং বডির সভাপতি ও কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এনে তাদের অপসারণের দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষাসহ যাবতীয় শিক্ষা কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বর্তমান গভর্নিং বডির প্রতি অনাস্থা জানিয়ে তা বিলুপ্তির দাবি জানিয়েছেন তারা।
এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত করে থাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর। এই অধিদপ্তরের ৪০টি তদন্ত রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এর মধ্যে অন্তত ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের মূল কারণ গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি। কমিটি কোটি কোটি টাকা আত্মসাত্ করেছে। অনিয়মের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে।
গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে যেখানে এত অনিয়ম চলছে, সেখানে এই কমিটি থাকার প্রয়োজন আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, বর্তমানে যে কাঠামোয় পরিচালনা পর্ষদ চলছে, তার পরিবর্তন করা দরকার। আর্থিক সুবিধা, নিয়োগ, কেনাকাটা থেকে এই কমিটিতে দূরে রাখতে পারলে অসাধু ব্যক্তিরা এই পর্ষদে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। ফলে ভালোভাবে চলবে কমিটি।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, খুলনার বিএল কলেজ, বরিশালের বিএম কলেজ, কারমাইকেল কলেজ, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজের মতো প্রতিষ্ঠান শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিচালনা করছে। সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয় ম্যানেজিং কমিটি-গভর্নিং বডির দরকার নেই বা বর্তমান কাঠামো পরিবর্তন করবে তাহলে আমরা সেভাবেই দেখভাল করব। প্রতিটি উপজেলায়ই শিক্ষা অফিস আছে। সরকারি স্কুলে ডিসির নেতৃত্বে মনিটরিং কমিটি আছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার এ প্রসঙ্গে বলেন, পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আমাদের কাছেও আসে। তবে নতুন বিধিমালা তৈরি করা হচ্ছে।
তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশেষ পরিস্থিতি ‘এডহক কমিটি’ গঠনের এখতিয়ার রয়েছে শিক্ষা বোর্ডগুলোর। এই এডহক কমিটির মেয়াদ ছয় মাস। এই সময়ের মধ্যে রুটিন কাজ ছাড়া কোনো ধরনের নিয়োগ বা বড় ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না এডহক কমিটি। এই সময়ের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ নিয়মিত কমিটি গঠন করতে হয়। নিয়মিত কমিটির মেয়াদ দুই বছর। সংশোধিত বিধিমালায় অনুমোদন হলে বিশেষ কমিটি গঠন করা যাবে। এই কমিটি নিয়মিত কমিটির মতোই সব দায়িত্ব পালন করতে পারবে। যেসব প্রতিষ্ঠানে কমিটি নিয়ে দীর্ঘদিন দ্বন্দ্ব চলছে, সেসব প্রতিষ্ঠানে এই বিশেষ কমিটি গঠন করা হবে বলে বোর্ডের চেয়ারম্যান জানান।
এদিকে রাজধানীর আজিমপুর এলাকার একটি নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ বিভিন্ন দপ্তরে জমা হয়েছে বলে জানা গেছে। সেখানে বলা হয়েছে, শিক্ষার মানের দিকে গভর্নিং বডির কোনো নজর নেই। শিক্ষক নিয়োগসহ বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটায় তারা ব্যস্ত থাকেন। বিভিন্ন বিল ভাউচার বানিয়ে টাকা তুলে নিয়ে যান। শিক্ষকদের মধ্যে বিরোধ তৈরি করেন। যেসব শিক্ষকের গভর্নিং বডির সদস্যদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে তারা পাঠদানে অমনোযোগী। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন কমিটিতে তাদের রাখা হয়। গভর্নিং বডির ছত্রছায়ায় কোনো কোনো শিক্ষক প্রাইভেট কোচিংয়ে জড়াচ্ছেন। শিক্ষকদের কাছে কোচিং পড়ার জন্য শিক্ষার্থীদের ফোনে এসএমএস দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখছেন না । এ কারণে প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার ফল প্রতিনিয়ত খারাপ হচ্ছে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৫/০৮/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়