ওভার প্যারেন্টিং ভালো নয়

সামিয়া আসাদীঃ সন্তানের মঙ্গল কে না চান। তবে, বিপত্তি ঘটে তখনই, যখন সন্তানের জন্য অতিরিক্ত ভালো চাইতে শুরু করি আমরা। কথায় আছে, ‘অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়’। সন্তানের জন্য অতিরিক্ত মঙ্গল চিন্তাও তেমনি একটি বিষয়। আমরা নিজেদের জীবনের না পাওয়াগুলো সন্তানের প্রাপ্তির খাতায় যোগ করতে গিয়ে মনের অজান্তেই সন্তানের ওপর কত ধরনের যে চাপ প্রয়োগ করি, তার ইয়ত্তা নেই। শুধু পুথিগত বিদ্যার পেছনে ছুটতে গিয়ে জীবনের অনেক জরুরি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আমাদের সন্তানরা। সন্তানদের মানুষ করার নামে যে অতিরিক্ত অভিভাবকত্ব ফলাচ্ছি আমরা, তার ফলাফল অনেক ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হচ্ছে।

দৈনিক ইত্তেফাকের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

কিছুদিন আগে এক মাকে দেখলাম, ছুটির পর বাচ্চা ক্লাস থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিস আজকে কী কী পড়িয়েছেন, তা নিয়ে রীতিমতো সওয়াল-জবাব শুরু করে দিয়েছেন। তার প্রশ্নবাণে অবুঝ শিশুটির অবস্থা কাহিল। ডায়ারিতে পড়া ঠিকমতো তোলা হয়নি বলে তাকে বকা দিচ্ছেন । এখন তো সন্তানের চেয়ে অভিভাবকদের প্রতিযোগিতা বেশি চোখে পড়ছে। এক হালি কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার পাশাপাশি তমুকে গানের ক্লাসে ভর্তি হলো, অমুকে তায়াকুন্দুতে ইয়োলো গ্রিন বেল্ট পেয়ে গেছে ইত্যাদি প্রেশারে অভিভাবকদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কোচিং, গানের ক্লাস, তায়াকুন্দুসহ যাবতীয় স্টিমরোলার চালাচ্ছেন তারা। সন্তানের চাওয়া পাওয়া কিংবা নিতে পারার ক্ষমতার দিকে না তাকিয়ে এ প্রতিযোগিতা নির্ভর ছুটে চলা অনেক সময় বিপজ্জনক হয়ে ওঠে সন্তানের জন্য। সন্তানকে সায়েন্সই নিতে হবে। ডাক্তারই হতে হবে। এরকম ‘ই’ প্রত্যয় যোগ করে দেন অনেক বাবা মা-ই। সন্তান কী চায়, সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।

প্রকৃতপক্ষে এক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয় তখনই, যখন আমরা সবকিছুতে সন্তানকে শ্রেষ্ঠ দেখতে চাই। ভাবখানা এমন সবাইকেই আইনস্টাইন হতে হবে। এই আইনস্টাইন হওয়ার চক্করে সন্তান কী চায়, সে কতটুকু নিতে পারবে সেদিক থোরাইকেয়ার করে বাবা-মায়েরা কেবল ছুটতে থাকেন। এখানেই শেষ নয়, অমুক আর তমুকের সন্তানের সাফল্য দেখে বার বারই নিজের সন্তানকে হেয় করতে থাকেন। আপনার এ ধরনের তুলনা সন্তানকে শুধু অসুস্থ প্রতিযোগিতার দিকেই ঠেলে দেয় না, আত্মবিশ্বাসকেও গুঁড়িয়ে দেয়, যার পরিণতি আরো ভয়ংকর। অথচ সন্তানদের শেখানো উচিত প্রতিযোগিতা যদি করতেই হয়, তা হবে কেবল নিজের সঙ্গে। নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। কিন্তু এটা আমরা অনেক সময় উপলব্ধি করতে পারি না।

আধুনিক সমাজে সবাই বিচ্ছিন্ন। নিউক্লিয়ার পরিবারে বেড়ে উঠছে সন্তানেরা। বাবা-মায়ের বাইরে দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা-ফুফু, মামা-খালাদের সংস্পর্শ নেই বললেই চলে। এ বিচ্ছিন্ন বিলাসিতা আমাদের এবং পরবর্তী প্রজন্মকে মানসিক ভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে। এ অবস্থায় কেবল অভিযোগ আর অনুযোগের কাঠগড়ায় সম্পর্কগুলোকে না দাঁড় করিয়ে সহজ আর একটু উদারতার চোখে দেখতে পারলেই জীবন সুন্দর ও সার্থক হয়ে উঠবে। দেখা যায়, আমাদের দেশে সন্তানকে ঝুট-ঝামেলামুক্ত জীবন দিতে চান অনেক বাবা মা-ই। অতি আরাম-আহ্লাদ, ফুলের টোকাটি গায়ে না যেন লাগে প্রেক্ষিত তৈরি করে সন্তানদের বড় করতে চান। এভাবে তারা হয়ে ওঠে ননির পুতুল। কিন্তু কণ্টকপূর্ণ যাপিত জীবনের বাস্তবতা সম্পূর্ণ আলাদা। সন্তানকে যতই আপনার শীতল ছায়ায় রেখে আরাম দেন না কেন, বাইরের কঠিন পৃথিবীর সঙ্গে লড়াইটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে একাই লড়তে হয়। কাজেই জীবন লড়াইয়ের ধারাপাত ঘর থেকেই শুরু করা প্রয়োজন। ঘরের জন্য আলু-পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে যেমন ঘর সামলানো শিখবে, তেমনি দেশের অর্থনীতির হাল-চালও বুঝতে পারবে। নিজের ঘর পরিষ্কার করা, মেহমান আপ্যায়ন, ছোটখাটো রান্না, বিভিন্ন বিল দেওয়াসহ নানা কাজে সন্তানদের অংশ নিতে দিন। এই ছোট ছোট অংশগ্রহণই একদিন বড় কাজ করার রসদ জোগাবে। এতে করে চারদিক সামলিয়ে জীবনে কীভাবে এগিয়ে যেতে হয় এবং নেতৃত্বের মৌলিক গুণাবলির দীক্ষা ছোটবেলা থেকেই পাবে সন্তানরা। চাহিবা মাত্র সন্তানের সব শখ পূরণ করতে পারলেই ভালো বাবা-মা হয়ে গেলাম, তা-ও সব সময় সত্য নয়। মিনিমালিজমের চর্চা এখানে জরুরি। অল্পতে তুষ্ট থাকা, সাধারণ জীবনে অভ্যস্ত থাকার চেষ্টা, নিজের শখগুলোর যত্ন নেওয়া, মানুষের বিপদে এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষা পরিবার থেকেই শুরু হওয়া প্রয়োজন। জীবনে কেবল ভালো ছাত্র হওয়ার পেছনে না দৌড়িয়ে ভালো মানুষ হওয়ার চর্চা জারি রাখা গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারকে হতে হবে এসব শুভচর্চার সূতিকাগার।

বাবা-মা হিসেবে আমাদের কর্তব্য কী? আমরা আমাদের সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখব, তাদের স্বপ্ন দেখাব। সন্তানের জীবনে কীভাবে সফলতা আসবে বা কীভাবে তাকে তৈরি করব, তা নিয়ে অবশ্যই আমাদের সঠিক পরিকল্পনা জরুরি। তবে প্যারেন্টিংয়ের নামে ওভার প্যারেন্টিং করে ফেলছি কি না, সে বিষয়ে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। সারা দিন সন্তানের পেছনে না থেকে তাকে কোয়ালিটি সময় দিতে হবে। তাদের আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করতে হবে। মনে রাখা দরকার, সন্তানের প্রথম বিদ্যালয় হচ্ছে পরিবার। নৈতিক শিক্ষা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীল আচরণবিষয়ক শিক্ষা সন্তান বাবা-মায়ের কাছ থেকেই শেখে। পরিবারে আমরা যে আচরণ করব, আমাদের সন্তানরা সেটাই শিখবে। অতএব, অভিভাবক হিসেবে আমরা সঠিক পথে আছি কি না, তা বিশ্লেষণ করা সবার আগে জরুরি। এক্ষেত্রে আত্মসমালোচনার বিকল্প নেই। বিকল্প নেই আত্মনিয়ন্ত্রণেরও।

লেখক :সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৪/০৯/২০২৩    

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়