মো. তানজিমুল ইসলামঃ সৃজনশীলতা বলতে আমরা এমন এক ধারনাকে বুঝি যেখানে আগে থেকেই কতিপয় বিষয়ের মানদণ্ড নির্ধারণ করা থাকে (যেমন একটি ধারণা, রসিকতা, সাহিত্যকর্ম, চিত্রকর্ম বা সঙ্গীত রচনা, সমাধান, একটি আবিষ্কার ইত্যাদি)। এটি সৃষ্টির যেকোনো প্রদত্ত কাজের পিছনে গুণগত প্রেরণা এবং এটি সাধারণত বুদ্ধি এবং জ্ঞানের সাথে জড়িত বলে ধারণা করা হয়। বর্তমান কালে সৃজনশীলতা শব্দটি প্রতিটি ক্ষেত্রে অনেক বেশি ব্যবহূত হচ্ছে। কোনো ব্যক্তি যদি উপরোক্ত গুণাবলি সম্পন্ন হয়ে থাকে, তাকে সৃজনশীল ব্যক্তি বলা হয় এবং বিশেষ ব্যক্তি হিসেবে তাকে সমাদৃতও করা হয়ে থাকে। এমনি করে শিক্ষাক্ষেত্রেও সৃজনশীলতার ব্যাপকতা পরীলক্ষিত হচ্ছে। খুব মোটা দাগে বলতে গেলে সৃজনশীল শিক্ষা বলতে একটি অভিনব এবং দরকারী উপায়ে শিক্ষাদানের কাজ যা মূল চিন্তা ও কর্মের বিকাশের সাথে সম্পর্কিত শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিকে উৎসাহিত করে। সৃজনশীল শিক্ষা সম্বন্ধে একজন শিক্ষক শেখার জন্য ছাত্রছাত্রীদের জন্য যে পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে এবং সেই পদ্ধতিগুলো ছাত্রছাত্রীদের ওপর এবং উৎপন্ন ফলাফলের ওপর সামগ্রিক প্রভাব উভয়কেই ফোকাস করে থাকে।
সৃজনশীল শিক্ষা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলেই সর্বাগ্রে আলোচনা করতে হয় সৃজনশীল শিক্ষকের কথা। বর্তমানে আমাদের দেশের বিদ্যালয়গুলোতে যে ধরনের সিলেবাস বিদ্যমান রয়েছে, বাস্তবতার নিরিখে কি আদৌ তেমন সৃজনশীল শিক্ষকের সংখ্যা যথেষ্ট? প্রায় প্রতি বছরই পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন কি সৃজনশীলতারই অংশ? ষষ্ঠ শ্রেণির গণিত বই দেখে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষক দৌড়ে পালাতে পারলেই বাঁচে! গণিত বইতে ‘অঙ্ক’ বা সংখ্যার চাইতে কথা বা গল্পই যেন বেশি! জনৈক শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাইলে বলে বসে, ‘এ আপনি বুঝবেন না, একে সৃজনশীল গণিত বলা হয়!’ শিক্ষার্থীদের আজকাল পড়ার টেবিলেও কম দেখা যায়! সৃজনশীল শিক্ষার নামে বেশির ভাগ সময় ব্যয় করে তারা ছবি এঁকে, কারুকাজে বা নতুন কোনো উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে! বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে আসলেও ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীকে পড়ানোর মতো যোগ্যতাও যেন আমাদের হারাতে বসেছে আজকাল! সাহিত্যের রস শুকিয়ে গেছে! ব্যকরণের কোনো তোয়াক্কা না করেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চাষাবাদ চলছে হরহামেশাই! বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির স্বকীয়তা হারিয়ে গেলে কি বাঙালিপনাও হারিয়ে যায় না? সিলেবাস অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের ইংরেজির বেসিক তৈরিতে শিক্ষকদের আজকাল কোনো পরিশ্রম করার কথা নয়।
নীতি প্রণেতারা ধরেই নিয়েছেন, শিক্ষার্থীরা এ ব্যাপারে দক্ষ, তাই তারা সৃজনশীল পদ্ধতিতে ইংরেজি ভাষার চর্চা করতে পারবে অনায়াসেই! শিক্ষার্থীদের পরস্পরের মধ্যে ইংরেজিতে বাক্য বিনিময়ের আইডিয়াটি ভাবতে চমৎকার লাগলেও বাস্তবতার নিরিখে এটি নেহাতই কঠিন! শ্রদ্ধাভাজনেষু শিক্ষক মহোদয়গণের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই, পুরো দেশের যত শিক্ষক রয়েছেন, তারা কি সবাই (বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষকরা) ইংরেজি ভাষায় খুব সাবলীলভাবে তাদের শিক্ষার্থীদের সাথে বাক্য বিনিময়ে পুরোপুরি পারদর্শী? যদি তাই না হয়ে থাকে, তাহলে অতি সাধারণ ঘরের শিক্ষার্থী কেন অত সাবলীলভাবে ইংরেজিতে ভাব বিনিময় করতে শিখবে? যাদেরকে ইতোপূর্বে নিবিড়ভাবে ইংরেজি গ্রামারের শিক্ষাদান করা হয়নি, তারা কিভাবে অলৌকিকভাবে সৃজনশীল ইংরেজি শিখবে? এমনি করে বিজ্ঞান, সমাজ, সবকিছুতেই কেবলই সৃজনশীলতা! এত সৃজনশীলতার ভিড়ে মাঝেমধ্যে নিজেকে বড্ড বেশি বেমানান মনে হয়।
শিক্ষার্থীদের ঘর থেকে আজকাল পড়ার আওয়াজ শোনা যায় না! সরারাত জেগে ছবি এঁকে, কাগজ কেটে উদ্ভাবনী বস্তু তৈরি করে মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করে তারা! বিদ্যালয়গুলোতে পরীক্ষার সিস্টেম না থাকলেও দৈনন্দিন কর্মসূচিই যেন মূল্যায়নের অংশ বিশেষ! কী আর করার? শিক্ষনীতি বা সিলেবাসের বাইরে তো আর আমরা কেউ নই! যথারীতি সৃজনশীল পদ্ধতি মানতে বাধ্য আমরা সবাই! আমরা খুব ছেলেবলো থেকেই একটি বিষয় জেনে এসেছি, পড়ালেখা মানে পড়ালেখা! একজন শিক্ষর্থীর পূর্বশর্তই হলো তাকে নিবিড়ভাবে পড়তে ও লিখতে পারতে হবে এবং তা একটি চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সারজীবন চলতে থাকবে।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো- বিদ্যালয়গুলোতে আজকাল ক্লাস বা পড়ালেখার চর্চা নেই বললেই চলে!
অথচ শিক্ষার্থীদের হোমওয়ার্কের নামে ‘গল্প লেখা’, ‘কবিতা লেখা’ বা নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে চিত্রকর্মের কথা উল্লেখ করে দেয়া হয়! যে শিক্ষক নিজেই জীবনে কোনোদিন কবিতা লিখেননি বা গল্প লিখেননি এমনকি শিক্ষার্থীদের ওই বিষয়ে কোনো শিক্ষাদান করেননি, তারা কিসের ভিত্তিতে এতটা আশাবাদী হয়ে যান যে তাদের শিক্ষার্থীরা ‘গল্প লেখা’, ‘কবিতা লেখায়’ পারদর্শী হবে। বাস্তব চিত্রটিও যেন তাই অত্যন্ত ভয়াবহ! শিক্ষকের দেয়া এসাইনমেন্ট তৈরির জন্য শিক্ষার্থীরা গুগলে সার্চ দিয়ে তথ্য চুরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। জনৈক লেখক বা কবির কবিতার দু-একটি শব্দ পরিবর্তন করে নিজের নামে চালিয়ে দেয়ার কাজটি করতে তারা যেন পটু হচ্ছে! বিদ্যালয়ের শ্রেণিশিক্ষক সংশ্লিষ্ট ছাত্রের এহেন প্রতিভা দেখে সাময়িকভাবে খুশি হলেও বাস্তবে যেন তাদের চৌর্যবৃত্তিই শেখানো হচ্ছে। মোবাইল-ইন্টারনেটের যুগে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বই পড়ার প্রবণতা এমনিতেই অনেক কমে গেছে! উপরন্তু বিদ্যালয়ের পাঠদানে শিক্ষকদের যদি কোনো বাধ্যবাধকতাও না থাকে এবং শুধুমাত্র সৃজনশীলতার দোহাই দিয়ে সিলেবাস সম্পন্ন করা হয় তা হলে জাতি কী আশা করতে পারে এ প্রজন্মকে নিয়ে?
সীমিত সম্পদ আর সীমাহীন দুর্ভোগকে সাথে নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত পার করছে এদেশের আপামর জনগণ! শত সমস্যাকে উপেক্ষা করে এই সৃজনশীল পদ্ধতির শিক্ষায় তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলে। অনেক আশায় বুক বেঁধে তারা এভাবেই স্বপ্নের জাল বুনে, ‘নিশ্চয়ই তাদের সন্তানরা একদিন সংসারের হাল ধরবে!’, ‘শিক্ষিত সন্তান হয়ে মা-বাবা, দেশ-জাতির নাম অলঙ্কৃত করবে!’ সৃজনশীল শিক্ষার বদৌলতে পাবলিক পরীক্ষায় ছেলেমেয়েদের প্রত্যাশিত (কখনো আবার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি) ফলাফল দেখে মা-বাবা সাময়িকভাবে বড্ড খুশি হলেও বেলাশেষে তারা যেন একরাশ কালো অন্ধকারে দিনানিপাত করে।
সম্প্রতি অনার্স পড়ানো হয় এমন একটি কলেজের কথা উল্লেখ করা হলো : মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক উভয় পরীক্ষায় এ প্লাস প্রাপ্ত জনৈক শিক্ষার্থী স্নাতক (সম্মান) ভর্তিপরীক্ষায় সাইকোলোজি সাবজেক্টে ভর্তির সুযোগ পায়। ইংরেজিতে তিনি হয়তো সাইকেলোজি বানানটি জানতেন না, তাই প্রিন্সিপালকে বলেন, ‘স্যার আমি পিসিচোলোজি’ সাবজেক্টে ভর্তি হতে চাই’; এহেন উক্তি শুনে প্রিন্সিপাল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন! আর যাই হোক অন্তত : এ প্লাস প্রাপ্ত শিক্ষার্থী বলে কথা! সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থার এ যুগে প্রতি বছর যেভাবে পাসের হার ও ভালো রেজাল্টের হার বাড়ছে, সে অনুপাতে আদৌ কি তাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে? অথবা সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতিতে বেড়ে ওঠা সাধারণ শিক্ষার্থীরা কি স্বশিক্ষিত হতে শিখছে? তাদের রেজাল্টের যে গুরুত্ব সেভাবে কি তারা আত্মবিশ্বাসী হতে পারছে? তবে কি এ শিক্ষা কেবলই সান্ত্বনার।
নাকি একটি প্রজন্মের কাছে নিছকই এক প্রহসন মাত্র। প্রতি বছরই একাডেমিক শিক্ষার শিক্ষিতের হার বাড়ছে, সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থায় ভালো রেজাল্টের হারও কম নয়! শুধু দিনে দিনে কমে যাচ্ছে বই পড়ুয়াদের সংখ্যা! সৃজনশীলতার ভিড়ে দিনে দিনে বুনিয়াদি শিক্ষার মৌলিকতা হারাতে বসেছে! নিত্যদিনের তুচ্ছতা, গ্লানি, ও হীনমন্যতা এবং ক্ষুদ্রত্ব, সংকীর্ণতা , অসত্য ও মিথ্যাকে পরিহার করে সত্যানুসন্ধানী হওয়ার আহ্বান আজ খুব কমই শোনা যায়! এ যুগের শিক্ষার্থীদের কাছে এসব যেন পাগলের প্রলাপ বলে মনে হয় অনেক সময়।
সৃষ্টির সেরা জীব হওয়ার ফলে মানুষের মেধা-মননশীলতার প্রকাশ ঘটবে প্রতিটি ক্ষেত্রে, এটি খুব স্বাভাবিক ঘটনা। প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ প্রতি পদে পদে নতুনকে সৃষ্টি করে চলে কারণ মানুষ সৃজনশীল। মানুষ তার নিজস্ব শক্তি, সাধনা ও সৃজনশীলতা দিয়ে নতুন কিছু আবিষ্কার করে আসছে সেই বহুকাল আগে থেকেই। এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নতুন করে সৃজনশীলতার খুব বেশি প্রয়োজন নেই। অনেক ত্যাগ-তিতীক্ষার বিনিময়ে পাওয়া এ দেশে সৃজনশীল শিক্ষানীতি হবে; আমাদের সন্তানরাও সৃজনশীল হবে এবং তারা দেশ, মাটি ও মানুষের একাত্মতায় সম্পৃক্ত হবে- এত ভীষণ আনন্দের খবর! কিন্তু বাস্তবে এসব কি দেখছি আমরা? মা-মাটি-দেশের সংস্কৃতির মৌলিকতা বিকিয়ে দিয়ে তারা যেন গুগল নির্ভর পরজীবী হয়ে উঠছে! সত্যিকার অর্থে দেশ-জাতির জন্য এ সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির প্রজন্ম তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। মেধা-মননশীলতার ব্যবহার না করে করে বরং গুগল নির্ভর এ প্রজন্ম দিনে দিনে যেন অলস মস্তিষ্কের কারখানা হয়ে যাচ্ছে, যা কখনোই প্রত্যাশিত নয়। ক্ষণে ক্ষণে তাই প্রশ্ন জাগে মনে, এ কেমন সৃজনশীল শিক্ষা? খুব কি প্রয়োজন ছিল এ পদ্ধতির?
লেখক: কলামিস্ট ও উন্নয়নকর্মী
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১০/১০/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়