এমপিওভুক্ত শিক্ষক কী ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হতে পারবেন?

আল আমিন হোসেন মৃধা, নির্বাহী সম্পাদকঃ  শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার আয়নাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন পার্শ্ববতি নালিতাবাড়ি উপজেলার গোজাকুড়া নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের সহকারী শিক্ষক ও স্থানীয় যুবলীগ নেতা হাসানুজ্জামান। কমিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শেরপুর দায়রা জর্জ আদালতে দুইটি মামলা ও ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে এক অভিভাবকের অভিযোগ এবং স্থানীয় এক ব্যক্তির এমপিওভুক্ত শিক্ষক অন্য এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে সভাপতি হতে পারবে না মর্মে সহ অন্যান্য নানা অসঙ্গতি নিয়ে লিখিত অভিযোগ দেন শিক্ষা বোর্ডটির চেয়ারম্যান বরারব। জর্জ আদালতে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া স্বত্বেও নির্বাচন, তফসিল অনুযায়ী ঘোষিত দিনের পরের দিন সভাপতি নির্বাচন, দাতা সদস্য বাতিল, স্কুল রেখে উপজেলা শিক্ষা অফিসে সভাপতি নির্বাচনসহ নানা অভিযোগ করা হয়।

এই একটি অভিযোগের কপি আসে শিক্ষা বিষয়ক সংবাদ মাধ্যম শিক্ষাবার্তা ডট কমের অফিসেও। শিক্ষাবার্তা পক্ষ থেকে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. গাজী হাসান কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। নানা অভিযোগ থাকলেও একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক অন্য প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হতে পারবেন কি’না বিষয়টি নিয়ে তিনি ধোঁয়াশায় ছিলেন। প্রতিবেদককে তিনি বিষয়টি নিয়ে তাকে সহযোগিতা করতে বলেন।

এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন শিক্ষক অন্য একটি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি কিংবা অবিভাবক সদস্য হতে পারবেন কি’না এ বিতর্ক চলে আসছে বেশ কয়েকবছর ধরেই। প্রায়শই এ বিষয়টি নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতে পরেন শিক্ষা বোর্ড গুলো। এই বিষয়টি নিয়ে একেক বোর্ড একেক রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন যদিও ম্যানেজিং কমিটির প্রোবিধিমালায় সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক শ্রেণির কেউ অন্য কোন এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পদে থাকতে পারবেন না। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক প্রফেসর মোহাম্মদ আবুল মনছুর ভূঁঞা বলছেন, একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক সমমনা অন্য এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হতে পারবেন। অন্যদিকে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক মোঃ আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলছেন আমরা এই প্র্যাকটিস করি না। এরকম কোন কমিটির অনুমোদনের জন্য বোর্ডে এলে আমরা তা ফিরিয়ে দেই অন্য কোন ব্যক্তিকে সভাপতি দেওয়ার জন্য। আমরা শিক্ষকদের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হতে নিরুৎসাহিত করি।

আইনে যা বলা আছে

ম্যানেজিং কমিটির প্রবিধানমালা ২০০৯ এর ৭ এর উপধারা ২ ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে, কোন শিক্ষক কিংবা শিক্ষক শ্রেণির কেঊ ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হতে পারবেন না। প্রবিধানমালায় ‘শিক্ষক’ শ্রেণি বলতে অর্থ মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কোন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পূর্ণকালীন শিক্ষাদানের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি, এবং প্রদর্শক ও শরীরচর্চা শিক্ষকও ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবেন।

প্রোবিধানমালায় সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও তাহলে কেন একজন শিক্ষক সমমনা অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হচ্ছেন প্রশ্ন করা হলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক প্রফেসর মোহাম্মদ আবুল মনছুর ভূঁঞা শিক্ষাবার্তা ডট কম’কে বলেন, একজন শিক্ষক বলতে নিজ প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হতে পারবেন না। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক মাধ্যমিক স্তরের অন্য যে কোন দুইটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পারবেন।

প্রোবিধানমালায় কে বা কারা ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি করা হতে পারবেন তা স্পষ্ট করা আছে। উল্লেখ আছে, স্থানীয় সংসদ সদস্য (বর্তমান সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সংসদ সদস্য সভাপতি হতে পারবেন না) স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রথম শ্রেণির অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ও স্থানীয় সমাজসেবক।

একজন শিক্ষক স্থানীয় শিক্ষানুরাগীও হতে পারেন বলছিলেন অধ্যাপক  ভূঁঞা।

কেন একজন শিক্ষককে গভর্নিং বডির সভাপতি হতে নিরুৎসাহিত করা হয় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে

একজন শিক্ষক অনেক সময় পার্শ্ববর্তী উপজেলা বা অন্য কোন জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকেন তিনি সেখান থেকে কিভাবে নিজের এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করবেন বলছিলেন দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক মোঃ আবু হেনা মোস্তফা কামাল। তিনি বলেন, একজন শিক্ষক এমপিওনীতিমালা অনুযায়ী তার প্রতিষ্ঠানে সঠিক দায়িত্ব পালন করবেন। তাহলে নিজের দায়িত্ব সঠিক পালন করতে গেলে তিনি ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির দায়িত্ব কিভাবে পালন করবেন প্রশ্ন রাখেন তিনি। একই সাথে একই ব্যক্তি একাধিক পদে দায়িত্ব পালন করতে গেলে কোনটাই তিনি সঠিকভাবে পালন করতে পারেন না। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির উপর প্রতিষ্ঠানটির অনেক কিছুই নির্ভর করে।  মূলত এই কারণেই আমরা শিক্ষকদের নিরুৎসাহিত করি।

অন্যান্য বোর্ড কি করছে এ বিষয়ে

সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, যশোর ও রাজশাহী বোর্ডে কথা হলে যে কমন জায়গাটি পাওয়া যায় তা হচ্ছে একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক অন্য এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হতে পারবেন।

সিলেট বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা জানান, আইনগত কোন সমস্যা নাই। তবে আমরা নিরুৎসাহিত করি। একই সাথে দুই দায়িত্বপালন করতে গেলে যথাযথ তা পালন করা সম্ভব হয় না।

যশোর বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক মো: সিরাজুল ইসলাম শিক্ষাবার্তাকে বলেন, আমরা এখানে একজন শিক্ষককে নিজ প্রতিষ্ঠান বাদে অন্য একই শ্রেণির প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির অনুমোদন দেই।

চট্টগ্রাম ও বরিশাল বোর্ডেও একই প্র্যাকটিস করেন কর্মকর্তারা। তবে রাজশাহী বোর্ডের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কথা বলতে রাজী হননি।

কি বলছে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান  তপন কুমার সরকার শিক্ষাবার্তা ডট কম’কে বলেন, নিজ প্রতিষ্ঠান বাদে একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক একই শ্রেণির অন্য প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতি হতে আইনগত কোন বাধা নেই। আমরা এই প্রাকটিসটাই করি।

ম্যানেজিং কমিটির প্রবিধানমালা ২০০৯ এর ৭ এর উপধারা ২ ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে, কোন শিক্ষক কিংবা শিক্ষক শ্রেণির কেঊ ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হতে পারবেন না। প্রবিধানমালায় ‘শিক্ষক’ শ্রেণি বলতে অর্থ মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কোন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পূর্ণকালীন শিক্ষাদানের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি, এবং প্রদর্শক ও শরীরচর্চা শিক্ষকও ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবেন। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এই বিষয়টি শুধু নিজ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে হ্যা এটা ঠিক যে এখানে সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই যে নিজ প্রতিষ্ঠান কিংবা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে হতে পারবেন না। আমরা ২০০৯ সালের এই বিধিমালাটা সংশোধন করে নতুন করে প্রোবিধিমালা তৈরি করেছি। যেখানে বিষয়টি স্পষ্ট করা আছে। যদিও সেটা চুড়ান্ত প্রজ্ঞাপন দেইনি। প্রজ্ঞাপন দিলে সেটা সবার ক্ষেত্রেই ক্লিয়ার হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় যা বলছে 

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের  মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের বেসরকারি মাধ্যমিক অধিশাখার যুগ্ম সচিব সোনা মনি চাকমা শিক্ষাবার্তা ডট কমকে বলেন, একজন শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠান বাদে হতে পারবেন সে ক্ষেত্রে আইনগত কোন বাধা নেই। আমরা নতুন নীতিমালায় বিষয়টি স্পষ্ট করেছি। যদিও এটি এখনও প্রকাশ হয়নি।

 মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের মাধ্যমিক-১ অধিশাখার অতিরিক্ত সচিব খালেদা আক্তার যুগ্ম সচিব সোনা মনি চাকমার সুরেই একই কথা বললেন। তার কাছে ‘এমপিও নীতিমালায় একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক একই সাথে অন্য কোন চাকরি কিংবা আর্থিক লাভজনক কোন পদে থাকতে পারবেন না’ উল্লেখ্য রয়েছে জিজ্ঞেস করলে তিনি শিক্ষাবার্তা ডট কমকে বলেন, সভাপতি কোন আর্থিক লাভজনক পদ নয় সেক্ষেত্রে তিনি পারবেন।

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০১/৩০/২৩