মঞ্চদাস রফিক নটবর।।
এক ভদ্রলোক গণিতবিদ্যায় অসাধারণ এক কীর্তি গড়ে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাকে ভাবা হচ্ছে আইনস্টাইনের কাছাকাছি মেধাসম্পন্ন। তিনি অভিনন্দন ও সংবর্ধনায় ভাসছেন। তিনি যে স্কুলের ছাত্র ছিলেন সেখানেও তাঁকে সংবর্ধিত করা হচ্ছে। মানপত্র, পুষ্পস্তবক, প্রশংসাবাণীর সয়লাব শেষে সেই মানুষটির কিছু বলার পালা। ডায়াসে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, আপনারা আমাকে যা জানছেন, আমি আসলে তার কিছুই না। আমি গণিতে মহাপণ্ডিত নই, আসলে মহামূর্খ। আমি গণিতের কিছুই জানতাম না, জানি না।
লোকজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তিনি বলতে থাকেন, স্কুলে আমি গণিতে ছিলাম সবচেয়ে খারাপ। ক্লাস ফোর পর্যন্ত গণিতের খাতায় দুই অঙ্কের নম্বরও পাইনি। ফাইভে পেয়ে বসলাম গোল্লা। স্কুল থেকে টিসি দেওয়ার উদ্যোগ। এর মধ্যে বাঘা বাঘা হাউস টিউটর ফেল করেছেন। বাবা-মার ঘুম হারাম। আমার কাকা এসে বাবাকে বললেন, তিনি শেষ চেষ্টা হিসেবে একজন পাগলাটে টিউটর এনে দিতে চান। বাবা রাজি হলেন। কাকা-ই স্কুলে গিয়ে টিসি আটকালেন।
একদিন বিকেলে কাকা সেই মাস্টারকে বাড়িতে নিয়ে এলেন। মাস্টারকে দেখে আমার ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। অযত্নে লালিত তেলহীন চুল। দাড়ি-গোঁফ ক্ষুর দেখে না কতদিন কে জানে! চেহারা রোগা ও রুক্ষ। মোটরের টায়ারের চটি পায়ে। খদ্দরের ফতুয়াটা ময়লা। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগটা জাদুঘরে রাখার উপযোগী। ছেঁড়া অংশ দিয়ে একগুচ্ছ কাগজ ময়লা দাঁতের মতো বেরিয়ে আছে।
হাল-ছাড়া ভাব আমার বাবার মধ্যে। তবু তিনি আমাকে ডাকলেন। পরিচয় পর্ব শেষ। স্যার বললেন, আপনারা একটু যান। আমি আমার ছাত্রের সঙ্গে একা কিছু কথা বলব। সবাই চলে গেলে স্যার ঘরের দরজা আটকে দিলেন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। পাগলে আবার কী না করে বসে! হঠাৎ স্যার আমার হাত দুটি শক্ত করে ধরে বসলেন। তার পর তিনি করুণ সুরে বললেন, বাবা, তুমি আমাকে বাঁচাও। তুমিই আমাকে বাঁচাতে পারবে। কথা দাও, বাঁচাবে কিনা? আমি এবার নিশ্চিত হলাম- এ লোক পাগল শুধু নয়; বদ্ধ পাগল। স্যার বলেন, আমি গণিতের গ-ও জানি না।
কিন্তু টিউশনিটা আমার খুব দরকার। টিউশনিটা পেলে আমি দু-মুঠো খেয়ে বাঁচব, নইলে অনাহারে মারা যাব। তুমি আমার অজ্ঞতাকে গোপন করে যাবে। আমি এর মধ্যে কিছু পড়াশোনা করব, তুমিও করবে। তোমার চেষ্টা এবং আমার টিউশনি দুটিই চলুক। পরেরটা পরে বোঝা যাবে। বিপদ থেকে মুক্তির জন্য আমি রাজি হয়ে গেলাম তার কথায়।
সন্ধ্যার দিকে স্যার আসেন। এসেই করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন- বাবা, আমার টিউশনিটা আছে তো? কয়েক দিনে স্যারের চেহারাটা একটু ফিরে গেল আমাদের বাসার নাশতা-পানি পেয়ে। স্যার গণিত বোঝানোর বদলে প্রতিদিন চিরকুটে করে নতুন নতুন অঙ্ক লিখে আনেন। সমাধান তার জানা নেই। আমি সেই অঙ্ক নিয়ে বন্ধুদের কাছে যাই, স্যারদের শরণাপন্ন হই। নিজে নিজে সল্ভ করে গাইড বইয়ের উত্তরের সঙ্গে আমার উত্তর মিলাই।
স্যার এবার অঙ্কের প্রতিযোগিতা খেলা শুরু করলেন। একই অঙ্ক তিনিও করেন, আমিও করি। বইয়ের সঙ্গে রেজাল্ট মিলিয়ে যদি দেখি আমি পেরেছি, তাহলে ‘ওয়াও’ বলে উদ্বাহু নাচতে থাকি। স্যারও নাচতে থাকেন। বলা বাহুল্য, কোনোদিনই স্যারের উত্তর সঠিক হয় না। স্যার যথারীতি আমার হাত ধরে আকুতি জানান চাকরিটা রক্ষা করার।
কয়েক দিনে স্যারের প্রতি একটা মায়ার ডোর তৈরি হলো। তার চাকরি ও জীবন বাঁচাতে আমি অঙ্কে জীবন বাজি রাখলাম। অল্প সময়ের মধ্যে বুঝলাম, আমার সামনে থেকে আঁধারের আবরণটা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। আলোর রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
এলো ষাণ্মাসিক পরীক্ষা। গণিতে ৫০ পেয়ে গেলাম। স্যাররা অবাক। আমি কলার উঁচিয়ে স্যারদের বললাম, দেখেছেন কী! বার্ষিকে একশ’তে একশ’ কনফার্ম। স্যারদের কেউ বললেন, হুঁ, একশ’! কত পাগল দেখলাম!
আমি দম্ভের সঙ্গে বলে বসলাম, বাজি! বার্ষিক পরীক্ষার ফল আনতে গেছি স্কুলে। আমাকে নিয়ে রীতিমতো জটলা। স্যারদের চোখ কপালে। কীভাবে সম্ভব! সত্যি একশ’তে একশ’ পেয়েছি। দৌড়ে বাড়ি এলাম। হাতের উঁচানো রেজাল্ট কার্ড আমার বিজয় নিশান।
আমার রেজাল্টে বাবা তেমন উচ্ছ্বসিত হলেন বলে মনে হলো না। তিনি বললেন, চলো তোমার মাস্টারকে খবরটা দিয়ে আসি। বাবা আমাকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলেন এক হাসপাতালে। কোনার এক বেডে স্যারের স্যালাইন চলছে। বাবা স্যারের কানের কাছে মুখ নিয়ে আমার রেজাল্টের কথা বললেন। স্যার চোখ মেলে তাকালেন। তার মুখে এক স্বর্গীয় খুশির রেখা। বাবাকে তিনি শুধু বললেন, মনে থাকবে তো আমার অনুরোধ? সময়মতো ওকে জিনিসটা দেবেন কিন্তু।
দিন দুই পর স্যারের মৃত্যুর খবর এলো। এর মধ্যে গণিত আমার কাছে পানির মতো হয়ে গেছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে পড়ছি। বাবা একদিন স্যারের সেই ছেঁড়া ব্যাগটা আমাকে দিয়ে বললেন, তোমার স্যার তার জীবন-যৌবন বিসর্জন দিয়ে যে কাজটি করতে গিয়ে শেষ করতে পারেননি, সেটা শেষ করার দায়িত্ব তোমাকে দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘গণিতে শূন্য পাওয়া একমাত্র আমার এই ছাত্রই পারবে আমার গবেষণাকে সম্পূর্ণ করতে।’
আমি সেই ময়লা কাগজগুলো খুলে প্রথমে মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। পরে বুঝলাম, মৌলিক সংখ্যার ওপর তিনি এমন একটি গবেষণা প্রায় শেষ করার পথে ছিলেন, যা আজ পর্যন্ত কেউ করেনি। আমি আবার সেই স্কুলজীবনে ফিরে গেলাম। স্যারকে বাঁচাতে হবে, স্যারের অনুরোধ রাখতেই হবে। অল্প কিছু দিনেই আমি গবেষণাটি শেষ করলাম।
আমার নামে এটা প্রকাশিত হলো জার্নালে। চারদিকে পড়ে গেল শোরগোল। পুরস্কার-পদবিতে আমি ভাসলাম। এবার আপনারাই বলুন, আমি এত প্রশংসার যোগ্য কিনা? হলঘরে পিনপতন নীরবতা।
এই গল্পে প্রকৃত শিক্ষকের স্বরূপ নিহিত।
সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী অসাধারণ সব কথা বলে গেছেন এ বিষয়ে। তার মতে, বিদ্যা দান আর গ্রহণের উপকরণ নয়। শিক্ষক যেমন দাতাকর্ণ নন, তেমনি শিক্ষার্থীরা জ্ঞানভিখিরি নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভাঁড়ারই যখন শূন্য থাকে, তখন দাতাকর্ণ বা হাতেমতায়ী সাজা ভণ্ডামি বলেই পরিগণিত হতে বাধ্য।
আধুনিককালে শিক্ষা বা বিদ্যা বড়জোর শেয়ারিংয়ের জিনিস হতে পারে; দানের নয়। আমাদের দেশে বিশাল ক্লাসরুমে শিক্ষকের একমুখী বিদ্যাবর্ষণ আর যা-ই হোক শিক্ষার্থীর শিক্ষার জন্য স্বাস্থ্যপ্রদ নয়। মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য তো নয়ই। প্রমথ চৌধুরী শিক্ষককে বলেছেন উত্তর সাধক আর ছাত্রকে বলেছেন সাধক। উত্তর সাধকের কাজ সাধকের সাধনার আয়োজন করা, পরিবেশ নির্বিঘ্ন করা।
সিদ্ধিলাভ করতে কঠোর সাধনা করতে হয় সাধককেই। শিক্ষকের ভূমিকা শিক্ষার্থীর জ্ঞান সাধনার আয়োজন করা; জ্ঞান গিলিয়ে দেওয়া নয়। জোর করে বিদ্যা গেলানোর ফল ভালো হয় না।
জোর করে গুরুপাচ্য খাবার গেলানো হলে শিশুর যেমন স্বাস্থ্যহানি ঘটে, তেমনি জোর করা বিদ্যা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ডেকে আনে বিপদ। আমাদের দেশের প্রায় সব শিক্ষক এই জোরাজুরিতে জবর পারঙ্গম। তাদের জোরাজুরিতে শিক্ষার্থীর মানসিক ভগ্নস্বাস্থ্য কখনোই আর উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। আত্মবিকাশহীন শিক্ষিত শ্রেণির ভিড় তাই সমাজে বাড়ছে।