একজন আলোর দিশারী ছিলেন করিম উদ্দিন আহমেদ

।। খুরশীদুজ্জামান আহমেদ।।

লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার আলোকিত মানুষ আলহাজ্ব করিম উদ্দিন আহমেদ। জন্ম সাধারন কৃষক পরিবারে হলেও কর্মগুণেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ১৯৪৫ সালে ব্যবসার মাধ্যমে কর্মজীবনে হাতেখড়ি। কিছুদিন মাড়োয়ারীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চাকুরী।

পরে স্বল্প-পুজির ব্যবসা শুরু করেন। নানা মহলের আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ততার কারণে কোলকাতা, ভৈরব, নারায়নগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ঝালকাঠি, খুলনা ও সিলেটসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁর পাট ও তামাক ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়।

১৯৫৪ সালে ইউনিয়ন বোর্ডে নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে জনসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। একনাগাড়ে ১৬ বছর তিনি ইউনিয়ন বোর্ডে সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আমলে কালীগঞ্জে একটি উন্নয়ন পরিষদ গঠন করা হয়। তিনি এই পরিষদের সেক্রেটারি মনোনিত হন এবং উন্নয়ন কর্মকান্ডে অবদানের জন্য গভর্নর পুরস্কারে ভূষিত হন।

১৯৭০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। করিম উদ্দিন আহমেদ তরুণ বয়সেই ভারত ছাড় আন্দোলনে মুকুন্দ দাসের অন্যতম সহযোগী ছিলেন। তিনি এবা আন্দোলনের ভলান্টিয়ার হিসেবে তুষভান্ডার বাজারে খাজনা বন্ধ করতে গেলে গ্রেফতার হন। গরীব-দুঃখী মানুষের পাশে থেকে তাদের স্বার্থই তিনি উপলব্ধি করেছেন।

তাঁরই প্রেরণায় প্রথম শহীদ মিনার ‘চিরঞ্জীব কালীগঞ্জ’ নির্মিত হয়। তিনি ১৯৫৯ সালে কালীগঞ্জ করিম উদ্দিন পাবলিক পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠাকালের প্রথম সভায় তিনি বলেছিলেন-“ হাজার বক্তৃতার চেয়ে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করলে বক্তব্য পরিস্কার হয়। শিক্ষার সাগরে অনেক বড় বড় জাহাজ ভাসানো হয়েছে।

আজ আমি এক টুকরো কাঠ ভাসালাম, কারো উপকার হবে ভেবে ভাসাই নাই, মনের আনন্দে ভাসালাম। প্রাণের তাগিদে ভাসালাম, লাভ হলো কিনা ভবিষ্যতেই বলবে। ১৯৭২ সালে করিম উদ্দিন পাবলিক কলেজ (বর্তমানে এটি সরকারি)।

১৯৭৩ করিম উদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৯৭৩ সালে করিমপুর নেছারিয়া দাখিল মাদ্রাসা ও এতিমখানা এবং ১৯৮৬ সালে সুন্দ্রাহবি নেছারিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান রেখে গেছেন। ১৯৬৩ সালে ‘করিমপুর’ ডাকঘর প্রতিষ্ঠা করে অত্র এলাকায় ডাক যোগাযোগের সূচনা করেন। এজন্য এলাকায় তিনি এখনও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে আছেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় করিম উদ্দিন আহমেদ কালীগঞ্জ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ইপিআর, আনসার ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে তিনি মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। তার নিজস্ব বাসভবনে এর প্রধান কার্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৪ মাস এলাকাটি মুক্ত এলাকা হিসেবে থাকায় স্থানীয় যুবকদের এখানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এসময় তিনি কালীগঞ্জ করিম উদ্দিন পাবলিক পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে এক বিশাল জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।

পরে পাক-বাহিনী দখলের কারণে তিনি ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটা থানার ওকড়াবাড়ি ও পরে সিতাই থানার ভাড়ালিতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সম্মতিক্রমে তিনি দুটি যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাঙ্গালী যুবকদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগে তিনি মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেন।

এই সময়ে তিনি উত্তরাঞ্চলীয় মুক্তিবাহিনীর সংগঠক হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ কয়েক মাস তার বাড়িটি পাক-বাহিনী দখল করে নিয়েছিল। স্বাধীনতা উত্তরকালে বিধ্বস্ত এলাকাটি পুনর্গঠনে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। সীমান্তবর্তী ভারতীয় জেলা কোচবিহারের সরকারী কর্তৃপক্ষের সম্মতি নিয়ে তিনি এলাকার সর্বস্বহারা কৃষকদের মধ্যে হালের গরু বিতরণসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

তার একনিষ্ঠ প্রচেষ্টায় এলাকায় রংপুর-দিনাজপুর পল্লী সংস্থা (আরডিআরএস) কার্যক্রম চালু হয়। এই সংস্থার প্রধান মি. হুডনিকে এলাকায় নিয়ে এসে এর একটি কার্যালয় স্থাপন করেন।

১৯৭৩ সালে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। ১৯৮৫ সালে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে তিনি প্রথম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ১৯৯০ সালের ১৭ মার্চ তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র নুরুজ্জামান আহমেদ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে তাঁর হাতে রাজনীতির হাল ছেড়ে দিয়ে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

পরিবারে দুইজন স্ত্রী নূরজাহান করিম ও সামসুন নাহার করিমের মোট ১৩ জন সন্তান। স্ত্রী নূরজাহান করিম ২০১০ খ্রিস্টাব্দের ১১ জানুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন। জ্যেষ্ঠকন্যা শামসুন্নাহার আতিক আমেরিকায় বসবাস করেন। জ্যেষ্ঠপুত্র আলহাজ্ব নুরুজ্জামান আহমেদ ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে লালমনিরহাট- ২ ( কালীগঞ্জ, আদিতমারী ) আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই আলহাজ্ব নুরুজ্জামান আহমেদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিযুক্ত হন।

১৯ জুন ২০১৬ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে পুর্ণাঙ্গ দায়িত্ব প্রদান করা হলে ২১ জুন ২০১৬ সালে তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সরকারের পরবর্তী মেয়াদে পুনর্বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আস্থা অর্জন করায় ৭ জুন ২০১৯ সালে মন্ত্রী পরিষদে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। দ্বিতীয় পুত্র আলহাজ্ব মো রশীদুজ্জামান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, কালীগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধার সাবেক কমান্ডার ও সরকারি করিম উদ্দিন পাবলিক কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ।

কন্যা নুরুন নাহার আনোয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আইবিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী। কন্যা জাহান আরা ইকবাল অবসরপ্রাপ্ত উপ-সচিব জনাব ইকবাল হোসেনের স্ত্রী। কন্যা রওশন আরা আহমেদ ( চায়না) রংপুরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও রোটারিয়ান জনাব আলতাফ হোসেন চৌধুরীর স্ত্রী, রংপুর কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষকতা ছাড়াও রংপুর মহানগর আওয়ামীলীগের একজন সদস্য, রংপুর জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সংস্থার সাধারণ সম্পাদক। কন্যা জিন্নাত আরা অবসরপ্রাপ্ত ডা: হাফিজুর রহমানের স্ত্রী। পুত্র সামসুজ্জামান আহমেদ একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক।

পুত্র মাহবুবুজ্জামান আহমেদ দীর্ঘ ২০ বছর তুষভান্ডার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন বর্তমানে তিনি কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। পুত্র খুরশীদুজ্জামান আহমেদ কালীগঞ্জ করিম উদ্দিন পাবলিক পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। কন্যা আঞ্জমান আরা জাহিদ ‘ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্স এর কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কর্মকর্তা মরহুম জাহিদ হাসানের স্ত্রী। কন্যা ইশমত আরা জুই জীবন বীমা কর্পোরেশনের প্রধান কার্যালয়ের প্রশাসন বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড.আনিসুর রহমানের স্ত্রী। পুত্র ওয়াহিদুজ্জামান আহমেদ বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে রংপুর রিজিওনাল রিসোর্স সেন্টারের রিজিওনাল ডিরেক্টর।

করিম উদ্দিন আহমেদ শুধু রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিত্ব নন তিনি সাহিত্য ও সংস্কৃতি অনুরাগী ছিলেন। লোকসাহিত্য ও আঞ্চলিক ভাষার গবেষক ধর্মনারায়ন সরকার ভক্তিশাস্ত্রীকে তার রচিত গবেষণা গ্রন্থ ‘উত্তর বাংলার লোকসাহিত্য ও ভাষা গ্রন্থ’ প্রকাশে মুদ্রণ ব্যয় বহন করে তিনি উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় উপজেলার অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন অন্বেষা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা পায়।

১৯২৩ সালের ১৯ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন করিম উদ্দিন আহমেদ। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা মদনপুর বৈরাতীর ‘নিলাম্বড় পন্ডিতের’ পাঠশালায়। পরে রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার অন্তর্গত চিলাখাল পাইকান মাদ্রাসা থেকে তিনি খারিজি পাশ করে পাকুরিয়া শরীফ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। পরে তুষভান্ডার উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জের কীর্তিমান এই ব্যক্তিত্ব আলহাজ্ব করিম উদ্দিন আহমেদ ১৯৯১ সালের ২৮আগষ্ট তারিখ রংপুর মেডিকেল কলেজে ইন্তেকাল করেন।

প্রধান শিক্ষক

কালীগঞ্জ করিম উদ্দিন পাবলিক পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়

কালীগঞ্জ, লালমনিরহাট।