উচ্চশিক্ষা নিয়ে ১৩তম গ্রেডে বেতন প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য বৈষম্য

শাহানূর শাহিনঃ শিক্ষা যদি জাতির মেরুদন্ড হয়ে থাকে তবে শিক্ষকেরা হলেন শিক্ষার মেরুদন্ড। প্রাথমিক শিক্ষা হল বুনিয়াদী শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য “শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, মানবিক, নান্দনিক, আধ্যাত্মিক ও আবেগিক বিকাশ সাধন এবং তাদের দেশাত্মবোধে, বিজ্ঞান মনস্কতায়, সৃজনশীলতায় ও উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করা।

মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল এর আটটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে এর মধ্যে দুই নম্বর হল সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা। শিক্ষকেরা সমস্যায় থাকেলে শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করা কঠিন হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু স্বাধীন দেশের উপযোগী শিক্ষানীতি (কুদরাত ই খুদা) রিপোর্ট দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি। তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নির্দেশনাও দিয়ে যান।

কিন্তু তাকে হত্যার পর ক্ষমতাসীন সরকারগুলো শিক্ষার মৌলিক কোন পরিবর্তনে হাত দেয়নি। সে জন্য প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের পুরোটাই হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত দিয়ে।

এছাড়াও প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ জাতিয়করণ, শিক্ষা কারিকুলাম উন্নত বিশ্বের সাথে পরিবর্তন, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার, মূল্যায়ণ ব্যবস্থায় পরিবর্তন, সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মূল বেতন বৃদ্ধি এনটিআরসির মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান ইত্যাদি বর্তমান সরকারের সাফল্য।

শিক্ষার পরিবর্তন যদি শিক্ষকের হাত দিয়েই হয় তাহলে প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষকদের উন্নত জীবনমান, সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান যদি নিম্নমানের হয় তাহলে তাঁরা কীভাবে শিক্ষার্থীদের উন্নত জীবনের স্বপ্নদর্শনে উদ্বুদ্ধ করবে? শিক্ষার্থীরা যখন দেখে শ্রেণিকক্ষে তাদের শিক্ষককে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও কান ধরে ওঠা বসা করানো হচ্ছে।

একের পর এক এরকম ঘটনা ঘটেই চলেছে। জাতির কাছে জিজ্ঞাসা মেরুদন্ডহীন এই শিক্ষক সমাজ কীভাবে জাতির মেরুদন্ড সোজা করবে। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প বলা যেতে পারে বৃটেনের প্রয়াত দ্বিতীয় রানী এলিজাবেথ আকস্মিক একটি বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে দেখেন শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক চেয়ারে বসে পাঠদান করছেন। শিক্ষক রানীর সম্মানে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রানিকে সরি বলেন।

রানী তখন শিক্ষককে বলেন- আপনি সরি বললেন কেন? শিক্ষক উত্তর দিলেন- আমার শরীর খারাপ তাই চেয়ারে বসে ক্লাস নিচ্ছি। রানী বললেন- আপনি সবচেয়ে অন্যায় করেছেন আমাকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে। শরীর খারাপ হলে চেয়ারে বসে ক্লাস নিতেই পারেন। শিক্ষার্থীরা জানে শ্রেণিকক্ষে তাদের শিক্ষকের চেয়ে ক্ষমতাবান পৃথিবীর কেউ নন।

তাই আমাকে দেখে আপনার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ানো ঠিক হয়নি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাজার হাজার প্রধান শিক্ষকের পদ খালি থাকা সত্ত্বেও অযৌক্তিক মামলা, গ্রেডেশন ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অজুহাতে দফায় দফায় প্রমোশন পিছিয়ে যাচ্ছে।

প্রমোশন হলে কাজের গতি বাড়বে, শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে। দীর্ঘদিন পর প্রাথমিক বিদ্যলয়ের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণি ১০ম গ্রেড পদমর্যাদা দিয়ে হাইকোর্টের রায় সুপ্রিমকোর্ট বহাল রাখলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। তবে সম্প্রতি প্রধান শিক্ষকদের দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা টাইমস্কেলের সমাধান প্রশংসার দাবি রাখে।

শিশুদের নিয়ে কাজ করা এই মানুষগুলো চূড়ান্ত দক্ষ ও আন্তরিক। সংসারে টানপোড়েন থাকলে মনে আনন্দ থাকে না। আন্তরিকতা ছাড়া প্রাথমিকে কাজ করা সম্ভব নয়। পূর্বে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের গ্রেডের ব্যবধান ছিল এক ধাপ।

এতদিন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকে প্রধান শিক্ষকদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটলেও ১৩তম গ্রেডে থেকে সেই কর্মচারীই থেকে গেলেন সহকারী শিক্ষকরা। শোনা গিয়েছিল সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করে প্রমোশন দেওয়া হবে। যা আজ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। দেশে তিন লাখেরও বেশি সহকারী শিক্ষক প্রাথমিক শিক্ষায় সেবা দিয়ে আসছেন। এসব শিক্ষকের বেশির ভাগই অনার্স মাস্টার্স যোগ্যতা সম্পন্ন।

এখন এই উচ্চশিক্ষা নিয়ে ১৩ তম গ্রেডে বেতন পাওয়াটা শিক্ষকদের জন্য বৈষম্যের সমান। গ্রেড বৈষম্য দূর করে সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড প্রদানের বিষয়টি এখন সময়ের দাবি। এমনিতেই শিক্ষকতা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। তার ওপর তাঁদের কাজ করতে হয় অনেক সমস্যার মধ্যে দিয়ে, ভোটার তালিকা হাল নাগাদ, শিশু জরিপ, উপবৃত্তি ইউনিক আইডি খোলা ইত্যাদি।

স্কুলের কার্যক্রম সুন্দরভাবে চালাতে হলে সহায়ক স্টাফ জরুরি। যেসব বিদ্যালয়ে এখনো পিয়ন নিয়োগ দেয়া হয়নি সেসব বিদ্যালয়ে পিয়ন এবং সকল বিদ্যালয়ে একজন করে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর নিয়োগ দেওয়া জরুরি। এদিকে এমপিওভূক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে যাঁরা অবসর নিয়েছেন, তাঁরা অবসর ভাতার জন্য ব্যানবেইসের দুয়ারে মাথা ঠুকছেন।

আগামী শিক্ষাবর্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্তঃসম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন, শীতকালীন, ঈদ, পূজা এবং অন্যান্য সব ধরনের ছুটির অভিনব তারিখ ও সময় নির্ধারণ করা শিক্ষক শিক্ষার্থীর প্রাণের দাবি।

যে কোন সংকটকালে সংশ্লিষ্ট সব স্টেক হোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে দক্ষতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অব্যাহত রেখেছেন, সে দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আমাদের শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয় যতো বেশি আন্তরিক হতে পারবে ততো দ্রুত শিক্ষা ক্ষেত্রে সকল সমস্যার সমাধান হবে।

সকল স্তরের শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবী নিরসন করা হোক। সকল শিক্ষকদের এই হোক অঙ্গীকার যে, আমরা সকলে মিলে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটা সময়োপযোগী ও মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা গড়তে চাই। শিক্ষকরা বিশ্বাস করেন সম্মানও সম্মানী শতভাগ ফিরে পাবেন।

আমরা যা শিখেছি, যতোটা জেনেছি তার অধিকাংশটাই শিখিয়েছেন আমাদের শিক্ষকরা। সফলতার পিছনে থাকে শিক্ষকদের অবদান যাঁদের উপর ভর করে মাথা তুলে দাঁড়াই আমরা তাঁদের সকলের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : শিক্ষক-কলামিস্ট

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৯/১০/২০২৩    

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়