শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ ইসলাম ধর্ম সারা বিশ্বের মুসলমানদের এক সুতায় গেঁথেছে। তবে সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে দেশে দেশে মুসলমানদের নানা সামাজিক আচার পালনে রকমফের রয়েছে। এ কারণেই ইন্দোনেশিয়ার একটি মুসলিম পরিবারের ইফতার আয়োজন সৌদি আরবের একটি মুসলিম পরিবার থেকে ভিন্ন।
মিসরীয়রা পরিবারের সবাই মিলে ইফতার করতে পছন্দ করেন। ইফতারের সময় জ্বালানো হয় রঙিন লন্ঠন। রোকাক নামে একটা মচমচে ভাজা টোস্ট, যা তৈরি হয় মাংস দিয়ে, ইফতারিতে খুব জনপ্রিয়। এ ছাড়া ‘ফুল মেদেমাস’ ও বাদামি রুটি খেয়ে থাকেন তাঁরা। ফুল মেদেমাস আসলে মটরশুঁটি, টমেটো ও বাদাম দিয়ে তৈরি একধরনের খাবার। এটি রান্না করা হয় অলিভ অয়েল দিয়ে। মিসরীয়দের ইফতারে হাঁসসহ নানা ধরনের মাংসের পদ থাকে।
ইফতারে সৌদিরা ‘অ্যারাবিক কফি’ পান করেন। আর খেজুর তো থাকেই। সুপ, ভাজা অথবা বেক করা নানা রকম পুর ভরা পেস্ট্রি খেয়ে থাকেন তাঁরা। আর সৌদির পূর্বাঞ্চলের লোকেরা ইফতারে সালুনা নামের একটি খাবার খান, যা মাংস ও সবজির স্টু দিয়ে তৈরি। সৌদি আরবের তাবুক শহরে আড়াই দশক ধরে বাস করছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাজী নাসরুল। জানালেন, সৌদিরা খেজুর ও ক্রিমজাতীয় খাবার খেয়ে নামাজ পড়তে যান। এরপর লেবন হালিব, যা আমাদের দেশের বিরিয়ানির মতো ও মিষ্টিজাতীয় খাবার হারিসা কোনাফা খেয়ে থাকেন।
লেবাননে ইফতারের সময় ঘোষণা করতে প্রতিদিনই কামান দাগা হয়। ইফতারে ফাত্তুশ সালাদ নামে জনপ্রিয় একটি খাবার তাঁদের পছন্দ। গাজর, টমেটোসহ সব রকমের মৌসুমি ফল দিয়ে খাবারটি তৈরি হয়। এর ওপরে আবার ছড়িয়ে দেওয়া হয় রুটির টুকরা।
মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ জর্ডানের মুসলমানদের ইফতার শুরু হয় দধি, স্যুপ ও জুস দিয়ে। তাঁদের প্রিয় একটি খাবারের নাম মানসাফ। ভেড়ার মাংস দিয়ে তৈরি খাবারটি পরিবেশন করা হয় অ্যারাবিক রুটি বা ভাত সহযোগে।
ইরাকে শুকনো অ্যাপ্রিকট ও তেঁতুল দিয়ে একধরনের শরবত বানানো হয়। ইফতারে সবার পছন্দ এই শরবত, যা দূর করে সারা দিনের তৃষ্ণা।
ইফতারে ইরানের ঘরে ঘরে তৈরি হয় জাফরানের ঘ্রাণযুক্ত একধরনের হালুয়া। আর নামাজ শেষে তারা খায় স্যান্ডউইচ, মিষ্টি চা, তাবরেজি চিজ। আশ রাসতেহ নামে একটি ঘন সবজির স্যুপও সেখানে ইফতারের সময় আগ্রহ নিয়ে খাওয়া হয়।
ইফতারকে মালয়েশিয়ানরা বলেন ‘বারবুকা পুয়াসা’। খেজুর ও পানি দিয়ে ইফতার শুরু করেন তাঁরা। বান্দুং ড্রিংক, আখের রস, সয়াবিন মিল্ক নামের রকমারি পানীয় থাকে। ভারী খাবারের মধ্যে থাকে চিকেন রাইস, নাসি লেমাক, লাকসা।
পড়াশোনার জন্য ইন্দোনেশিয়ায় ছিলেন ঢাকার তরুণ মেহেদী হাসান। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। মেহেদী জানালেন, ইন্দোনেশিয়ার মানুষ ইফতারে ছোট সামুদ্রিক মাছ (আমাদের কাচকি মাছের মতো) ভেজে নেয়। এরপর তা বাদাম দিয়ে পরিবেশন করেন। সঙ্গে বিন ও চিকেন দিয়ে করে বারবিকিউ। ফ্রাইড রাইস থাকে। শরবত আলাদা করে তেমন বানান না। বাজারে বিভিন্ন ড্রিংকস কিংবা ডাবের পানি থাকে।
মালদ্বীপের মুসলমানরা ইফতারে গারুধিয়া নামে একটি খাবার খেয়ে থাকেন। এটা একটা মাছের পদ, যা পরিবেশন করা হয় ভাত, লেবু, মরিচ ও পেঁয়াজ দিয়ে। আরেকটি জনপ্রিয় খাবারের নাম কুলহি বোয়াকিবা। এটা একটা ঝাল ঝাল ফিশ কেক। আরেকটি খাবারের নাম থারিদ, যা বানানো হয় চাল ও গরু বা খাসির মাংস দিয়ে।
শ্রীলঙ্কার মুসলমানদের ইফতারে বিভিন্ন খাবারে নারকেলের দুধের ব্যবহার বেশি। এ ছাড়া আদিক নামে একটি রুটি তাঁরা খেয়ে থাকেন।
ভারতে ঐতিহ্যবাহী হায়দরাবাদ শহরে ইফতার শুরু হয় সুস্বাদু হালিম দিয়ে। অপর দিকে কেরালা ও তামিলনাড়ুর মুসলমানরা ইফতার করেন নমবু কাঞ্জি নামে একধরনের খাবার দিয়ে। মাংস, সবজি ও পরিজ দিয়ে প্রস্তুত করতে হয় খাবারটি। সঠিক স্বাদ পেতে চুলায় দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রাখতে হয়। উত্তর ভারতে পথের খাবার খুবই জনপ্রিয়। ইফতারের সময় এসব দোকানে ভিড় লেগে যায়। নানা রকম খাবারের পাশাপাশি ফ্রুট সালাদ তো থাকেই। এ ছাড়া দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে ইফতারের শুরুতে থাকে খেজুর, তাজা ফল, ফলের রস। এরপর পাকোড়া, সামোসার মতো ভাজা আইটেম। প্রসঙ্গত, ভারতে মুসলমানদের একটি অংশ মসজিদেই ইফতার করেন।
অপর দিকে অভিবাসী মুসলমানরা সাধারণত নিজ দেশের খাদ্যাভাসকেই লালন করেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় নানা জাতির বাস। সেখানে মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারতীয়। এরপর পাকিস্তানি, বাংলাদেশি, মিসরীয় ও আলজেরীয়দের স্থান। সবাই ইফতারে যাঁর যাঁর দেশের-সংস্কৃতির খাবারে খেয়ে থাকেন। কেপটাউন থেকে মনসুর আলম জানালেন, স্থানীয় মানুষের মধ্যে মুসলমান নেই বললেই চলে। প্রবাসীরা সবাই নিজ নিজ দেশের খাদ্য সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেন। মিসরীয়রা রুমালি রুটি, গ্রিলজাতীয় খাবার, দোসা—এসব খেয়ে থাকেন। ভারতীয়রা ফল ও পাকিস্তানিরা দুধজাতীয় খাবার বেশি খান। বাংলাদেশিরা জিলাপি, পেঁয়াজি, মুড়ি—সবই বানান।
নিউইয়র্কের বাঙালি এলাকায় একেবারে ঢাকার বাজারের মতোই ইফতারির হাট বসে। সেখানে ছোলা, পেঁয়াজি, বেগুনি, পাকোড়া, হালিম, জিলাপি, বুরিন্দা—সবই পাওয়া যায়। ইফতারে এসবই খাওয়া হয়। সেখানকার বাসিন্দা কুলসুম আক্তার বলছিলেন, দ্বিতীয় প্রজন্মের তরুণেরা ইফতারে কিছুটা আমেরিকান ধরনের খাবার, যেমন বার্গার, পাস্তা, সিরিয়াল, ফ্রুট কাস্টার্ড, সালাদ খেয়ে থাকে।
একই চিত্র লন্ডনেও। সিলেটিদের ইফতারে কাঁচা ছোলা, পাতলা খিচুড়ি থাকবেই। তবে মুড়ি থাকে না। চট্টগ্রামের লোকদের জন্য মুড়ি ও চিড়ার শরবত আবশ্যক। অনেকেই নতুন নতুন পদের স্বাদ নিতে চান। প্রথম রোজায় তাঁর বাসায় ইফতারে কুমড়া দিয়ে বেগুনি বানানো হয়েছে বলে জানালেন।
কানাডায় রোজা ১৪ ঘণ্টা। আজান শোনার ব্যবস্থা নেই। অ্যালার্ম বাজলেই ইফতার শুরু হয়। কেউ অফিস থেকে ফেরার সময় কেনা কাবাব-রুটি-বিরিয়ানি দিয়ে ইফতার সারেন। আর অফিসে থাকলে ১৫ মিনিটের বিরতি নিয়ে খেজুর-পানি মুখে দিয়েই ইফতার শুরু করেন।
সূত্র: বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার সূত্র এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৭/০৩/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়