ইংরেজি ভাষা শিক্ষা অর্জনের গুরুত্ব

ইফতেখার হোসেন সিদ্দিকী
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা হলেও ইংরেজি আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ একটি ভাষা। বলা যায় ইংরেজি আমাদের দ্বিতীয় ভাষা। এটি ঠিক ব্রিটিশরা প্রায় দুশ বছর এই উপমহাদেশ শাসন করে তাদের ভাষা ইংরেজি এখানে প্রবর্তন করেছিলেন। ব্রিটিশ আমলে এদেশের পাঠ্যপুস্তক ইংরেজিতেই পঠিত হত। ব্রিটিশ সরকার তাদের প্রশাসনিক কর্মকা-ে গতিশীলতা আনয়নের জন্য ইংরেজি ভাষার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজ আমলে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা বিস্তারে বা বলার ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা যেভাবে স্বাগত জানিয়েছিল মুসলিমরা সেভাবে স্বাগত জানায়নি। এ প্রসংগে আমি আমার মা’র বিষয়ে কিছু বলতে চাই তাহলো গত চলি্লশের দশকে তিনি তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী এবং পঞ্চম শ্রেণি শেষে দাদার নিষেধের কারণে ওনার (মা’র) আর বিদ্যালয় যাওয়া হয়নি। কারণ ঐ একটাই দাদা তার নাতনিকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে আগ্রহী ছিলেন না। আমার মা আজও ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারেন না। এটা তার জন্য একটি বিরাট দুঃখ। আমি মাঝে মধ্যে মা’কে ইংরেজি পড়ে শোনালে এবং আমার ইংরেজি বলার ধরন শুনে তিনি খুব খুশি হন এটি আমি বুঝি। যাই হোক আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে যখন প্রত্যাশিত মানের ইংরেজি ভাষা জ্ঞান না পাই তখন মনটা ব্যথিত হয়। আমরা জানি, চারটি মানদ-ের ওপর ইংরেজি ভাষার দক্ষতা নির্ভর করে। এগুলো হলো শোনা, বলা, পড়া ও লেখা। আমাদের শিক্ষার্থীদের মাঝে এগুলোর চর্চা নেহায়েত কম। তাইতো আমরা দেখছি এদেশের প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ইংরেজির ভিত অন্ত্যন্ত দুর্বল। জাতীয় পর্যায়ের এক জরিপে দেখা যায় প্রাথমিকে তৃতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজি বিষয়ের পঠন-পাঠন আশানুরূপ নয়। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীর ইংরেজি ভাষা জ্ঞান অত্যন্ত দুর্বল। তারা ভালো করে ইংরেজি পড়তে ও লিখতে পারে না। আর মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এটা তো ঠিক যে, বিশেষজ্ঞ ইংরেজি স্যারের অনেক চাহিদা। তারা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষণ-শিখনকে শ্রেণিকক্ষে দেয়া অপেক্ষা কোচিং সেন্টারে দিতেই বেশি আগ্রহী। তাইতো অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীরা এই সমস্ত কোচিং সেন্টারে রীতিমতো লাইন দিয়ে তাদের (শিক্ষার্থীদের) নাম রেজিস্ট্রেশন করিয়ে থাকেন। একটি ব্যাচে অনেক শিক্ষার্থীদের নিয়ে একজন শিক্ষকের পক্ষে পাঠদান যতটুকু না ফলপ্রসূ হয় তার থেকে এখানে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যের চিত্রটি ফুটে উঠে। বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের কাছে ইংরেজি শিখাতে পাঠিয়ে অভিভাবকরা একটু তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেন। কিন্তু বাস্তবতা কী? অর্থাৎ শিক্ষাথীরা কতটুকু ইংরেজি শিখছে এটি একটি পরিসংখ্যান থেকে সহজে অনুধাবন করা যায়। সেটি হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায় চলি্লশ হাজার পাঁচশ পঁয়ষট্টি পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র দু’জন ইংরেজি বিভাগে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছিল। ২০১৬ সালে গ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ৯০ ভাগ পরীক্ষার্থী ফেল করে ইংরেজিতে। আমাদের দেশের ইংরেজি বিষয়ের এই তথৈবচ অবস্থা দেখে শিক্ষাবিদরাও হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে একটি শিক্ষা জীবন শেষে (একাডেমিক ইয়ার) শিক্ষার্থীরা যখন ইংরেজিতে দুর্বল থেকে যায় তখন তা হয় দেশের জন্য বোঝা স্বরূপ। বর্তমান যুগ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। এখানে ইংরেজি ভাষা জ্ঞান প্রয়োগ করেই আমাদের বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে হয়। বিদেশে কর্মসংস্থান (ইংরেজি জ্ঞান ভালো হলে এটি দক্ষতা হিসেবে ভাবা হয়), গবেষণা, ব্যবসা-বাণিজ্য, উচ্চ শিক্ষা প্রতিটি সেক্টরে রয়েছে ইংরেজির গুরুত্ব। যদিও ইংরেজি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা তথাপি, ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে আমরা যেন এক প্রকার লজ্জাবোধ করি। ইংরেজি ভাষা জ্ঞান আমাদের এতই দুর্বল যে, আজকাল ফেসবুকেও দেখছি একের সাথে অন্যের মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাটাকে ইংরেজিতে রূপ দিয়ে লিখছেন। এতে আসলে নতুন বাংলিশের একটি ব্যাপার ঘটছে। মনের ভাব প্রকাশে প্রকৃত ইংরেজি ভাষার ব্যবহার খুব কম দেখা যায়। এটাও সত্য অনেকে বিএ, এমএ পাস করেও দু’চারটি ইংরেজিতে কথা বলতে পারছে না। এটি কি শিক্ষা ব্যবস্থাপনার চ্যুতি নাকি ইংরেজি ভাষা শিক্ষা অর্জনে অনিহা এ বিষয়টি আরো বেশি করে ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। বর্তমানে শিক্ষার চালচিত্র দেখে মনে হয় শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট অর্জনটাই মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলশ্রুতিতে আমাদের শিক্ষার্থীরা ঠকছে। তারা শিক্ষার গভীরে যেতে পারছে না। যা পড়ছে তা গদবাঁধা পড়ালেখা। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি নিজের ইংরেজি শিক্ষা অর্জনের আগ্রহ, দক্ষতা, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । আজকাল আধুনিক যে সমস্ত প্রযুক্তি আমাদের হাতের নাগালে আছে যেমন ফেসবুক, ইউটিউব, বিভিন্ন এ্যাপস্ ইত্যাদি ব্যবহার করে, ইংলিশ মুভি, বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরা ইত্যাদি চ্যানেল নিয়মিত দেখে, শুনে একজন ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে উঠতে পারে। ইংরেজি ভাষায় সাবলীলতা অর্জনের জন্য পরিবেশও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিজ পরিবার, বিদ্যালয় বা চারপাশের মানুষ জনের সাথে ইংরেজিতে বেশি করে কথা বলার আগ্রহ থেকে ইংরেজি ভাষা প্রয়োগের একটি পরিবেশ হতে পারে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষণ শিখানোর ক্ষেত্রে ইংরেজি ক্লাসে শিক্ষককে যেমন শিক্ষার্থীদের সাথে ইংরেজিতে কথা বলার মনমানসিকতা থাকতে হবে তেমনি শ্রেণিভিত্তিক প্রান্তিক যোগ্যতা ও শিখন ফল অর্জন নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষককে। এছাড়া ইংরেজি ভাষার প্রসারে সরকারের উদ্যোগে বয়স উপযোগী বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়া যেতে পারে। মোদ্দা কথা ইংরেজিতে দক্ষ জনগোষ্ঠী দেশের প্রয়োজনেই গড়ে তুলতে হবে, এতে দেশের উন্নয়ন আরো ত্বরান্বিত হবে।