আলোকিত সমাজ গঠনে মূলমন্ত্র বইপড়া

মোহাম্মদ এনামুল হকঃ মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। জন্মগ্রহণের সময় মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টি করেন একবারে নিষ্পাপ ও নিষ্কলুষ রূপে। জন্মের পর থেকে শিশু বিস্ময়ে চোখ মেলে পৃথিবীর আলো দেখে এবং তার বাবা-মা, তাকে ঘিরে থাকা আপনজন ও সামগ্রিক পরিবেশ থেকে সব বুঝতে শুরু করে। ধীরে ধীরে এসব থেকেই তার প্রথম শিক্ষা গ্রহণ শুরু হয়। পবিত্র কোরআনে সুরা আলাকের মধ্যে প্রথম পাঁচ আয়াতই হচ্ছে পাঠ করা কিংবা জ্ঞানার্জন সম্পর্কে। সুরা আলাকের সেই আয়াতগুলোর অর্থ হচ্ছে‘পড়ুন আপনার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্তপিণ্ড থেকে। আর আপনার রবই অনেক সম্মানিত ও দানশীল। যিনি মানুষকে কলম দ্বারা লিখন শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে এমন সব বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না।’ আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের অন্তত ৯২ জায়গায় জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার প্রসঙ্গ এনেছেন। ‘আল-কোরআন’ শব্দটির একটি অর্থ হলো ‘অধ্যয়ন’। পাঠের প্রতি উৎসাহ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা কোরআনের আরেক জায়গায় বলেন, ‘যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য। ইবনে মাজাহ।’

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, বই পড়লে যোগ্যতা অর্জন করা যায়। যোগ্যতা অর্জন করতে পারলে সমাজ, রাষ্ট্রসহ সব জায়গায় আলোকিত মানুষ হওয়া সম্ভব। বই পড়া মানুষ তাদের প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সমাজকে আলোকিত করতে পারে এবং নানা ক্ষেত্রে অবদান রাখার মাধ্যমে ভূমিকা রাখতে পারে দেশের উন্নয়নে। পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়তে হবে। এতেই নিজেকে বিকশিত করা সম্ভব। কোনো এক মনীষী বলেছিলেন, ‘কোনো এক অশিক্ষিত জাতিকে যদি মানসিকভাবে শিক্ষিত করতে চাও তাহলে তাদেরকে বই দাও।’ কথাটা ভুল বলেননি তিনি। মানবজীবনে বই এক পরম বন্ধু, পরম আশ্রয়। জীবনের বন্ধ দরজা-জানালাগুলো খুলে দেয়ার জন্য বইয়ের বিকল্প নেই। বইয়ের পাতায় সঞ্চিত থাকে হাজার বছরের জ্ঞানের সমুদ্র-কল্লোল। অতীত ও বর্তমানের অনন্য সেতুবন্ধ হলো বই। মানুষের মনোরাজ্যের দিগন্তকে প্রসারিত করে আলোকিত মানুষ হতে বইয়ের বিকল্প নেই। কারণ মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে গেলে জ্ঞানের বিকল্প নেই। টলস্টয় যথার্থই বলেছেন, ‘মানবজীবনের তিনটি অনুষঙ্গ হলোÑবই, বই, বই।’ আর এই বইপড়ার প্রথম দীক্ষা শুরু হয় ছাত্রজীবনে। ছাত্রজীবন হলো কবিতা, গল্প, উপন্যাস, থ্রিলার ও প্রবন্ধ পাঠের এক অমোঘ প্রহর। কিন্তু বর্তমানে মানুষ বই তেমন একটা পড়তে চায় না। একটা সময় ছিল, উৎসবে উপহার হিসেবে বইয়ের কদর ছিল সবচেয়ে বেশি। মধ্যবিত্ত পরিবারে এক আলমারি বই ড্রয়িং রুমের শোভা বাড়াত। মা-বাবারাও কোনো উৎসবে তাদের সন্তানদের বই উপহার দিতেন। এতে ছোটবেলা থেকেই শিশুরা পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্য বই পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠত। এখন আর তেমনটি চোখে পড়ে না। তার জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন মডেলের মোবাইল ফোন, আইপ্যাড, ল্যাপটপ, লাইক, টিকটক, পাবজি, দামি খেলনাসহ অনেক কিছু।

উন্নত বিশ্বে দেখা যায়, ট্রেন, বাস, রেলস্টেশনে যেখানেই সময় পাচ্ছে তারা বই পড়ছে। সেখানে বড় বড় শপিং মলে নানা রকম শোরুমের পাশাপাশি বইয়েরও মনকাড়া শোরুম থাকে। শিশু-কিশোরদের পাঠাভ্যাস কমে যাওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হলো, পাঠ্যবইয়ের বাইরে কোনো বই আমাদের সন্তান কিংবা ছাত্রদের পড়তে দিতে চাই না। পড়াশোনার ক্ষতির কথা বলে তাদের বই কেনা থেকে বিরত রাখা হয়। এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে এসে ছোটবেলা থেকেই তাদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন। বই পড়ার গুরুত্ব বোঝাতে বিভিন্ন দেশের দার্শনিক মনীষীরা অনেক মূল্যবান উক্তি করেছেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমাকে মারতে চাইলে চাকু, ছুরি কিংবা কোনো পিস্তলের প্রয়োজন নেই, বরং আমাকে বইয়ের জগৎ থেকে দূরে রাখো। নর্মান মেলর বলেন, ‘আমি চাই যে বই পড়া অবস্থায় যেন আমার মৃত্যু হয়। ওমর খৈয়াম বলেন, ‘রুটি-মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু একটি বই অনন্ত যৌবনা, যদি তেমন বই হয়।’

সামাজিক পরিবর্তনের ভূমিকা পালনকারী উপাদানগুলোর মধ্যে শিক্ষার গুরুত্ব সর্বাধিক। শিক্ষা মানুষের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটায়। মানুষের মধ্যে বিকশিত হয় নতুন মূল্যবোধের। বিশেষ করে বিশ্ব ইতিহাসে ১৭ শতক থেকে জ্ঞানের উল্লেখযোগ্য বিস্তৃত ঘটেছে এবং এর প্রভাবে সমাজ নিত্যনতুন উপাদানে সমৃদ্ধ হয়েছে। তাই দেখা যায়, যে সমাজের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ যত বেশি, সে সমাজে পরিবর্তনের হার ততই অধিক। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ নতুন নিয়মকানুন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারে। ফলে ব্যক্তিত্বের বিকাশ সহজতর হয়। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে সামাজিক পরিবর্তনের ওপর। শিশুশিক্ষা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় এবং সমাজকাঠামোর প্রতিটি স্তরে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধের পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব নিতে হয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে। মানবিক মূল্যবোধ দ্বারা তাড়িত সৎকর্মের দ্বারাই গড়ে তোলা সম্ভব সুন্দর বাসযোগ্য রাষ্ট্র, বৈষম্যহীন সমাজ ও আলোকিত পৃথিবী। মানুষই হচ্ছে একটি মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সুশীল সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার চালিকাশক্তি।

লেখক, আল হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৫/০৮/২০২৩  

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়