অ্যাওয়ার্ডের দরখাস্ত আহ্বান করাই প্রমাণ করে আমরা শিক্ষা-গবেষণায় কোথায় আছি

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন: ‘ইউজিসি স্বর্ণপদক’২০২২ প্রদানের জন্য ইউজিসি বাংলাদেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকে দরখাস্ত আহ্বান করেছে। প্রতি বছরই তারা এরকমভাবে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দরখাস্ত আহ্বান করে। এছাড়া সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা এই বিজ্ঞাপন চিঠি আকারে প্রচারের জন্য পাঠায়। ইন ফ্যাক্ট, শুধু ইউজিসি না, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন’স অ্যাওয়ার্ডসের জন্যও দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা আমার কাছে খুব অদ্ভূত আশ্চর্যের ব্যাপার লাগে। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে এমন ঘটে বলে আমার জানা নেই। অ্যাওয়ার্ড বিশেষ করে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষকদের অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার জন্য কীভাবে দরখাস্ত আহ্বান করে, আর শিক্ষক বা গবেষকরাইবা কীভাবে দরখাস্ত করে তা ইটসেলফ শিক্ষায় আমাদের দৈন্যতার বহিঃপ্রকাশ। পৃথিবীর কোনো দেশে এই পর্যায়ের মানুষদের অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার জন্য দরখাস্ত আহ্বান করে অথবা আহ্বান করলেই শিক্ষক বা গবেষকরা দরখাস্ত করে এমন উদাহরণ আমার জানা নেই। লজ্জা সরমের মাথা খেয়ে কীভাবে একজন অধ্যাপক মনে করতে পারে যে সে অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার যোগ্য।

Award has to be bestowed. দান এবং প্রদান করার মধ্যে যে একটা পার্থক্য আছে আমরা হয়তো সেটাও বুঝি না। দানের ক্ষেত্রে অর্থ সাহায্য, ভাতা, সেবা বা পোশাক, খেলনা, খাদ্য বা যানবাহন ইত্যাদি পণ্য সহ বিভিন্ন বিষয় যুক্ত থাকতে পারে। আর প্রদান শব্দের অর্থ হলো কোনো কিছু বিতরণ করা, তার জন্য নমিনেশন আহ্বান করা যেতে পারে। অর্থাৎ পিয়াররা নোমিনেট করবে। কেন করবে তা জাস্টিফাই করে পিয়াররা ইউজিসিকে জানাতে পারে। ইউজিসি-র গোল্ড মেডেল একটা বিরাট ব্যাপার। এর জন্য একটা উচ্চতর কমিটি অনেকদিন ধরে কাজ করে একজন স্কলার খুঁজে বের করবে যিনি কিনা এই অ্যাওয়ার্ড এর যোগ্য। সব কিছু ঠিক ঠাক হলে একজনকে যখন নির্বাচন করা হবে তখন তাকে একটি চিঠি বা টেলিফোনের মাধ্যমে জানানো হবে। যিনি এই চিঠি বা ফোন কল পাবেন তিনি আকাশ থেকে পড়বেন। খুশিতে আত্মহারা হবেন। এটি সংবাদ হবে। সবাই জানবে।

এই যে আমাদের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক নেচার, সায়েন্স, নেচার জিওসাইন্স, নেচার কম্যিউনিকেশন জার্নালের মতো বিশ^খ্যাত জার্নালে এতো এতো আর্টিকেল প্রকাশ করলেন তিনি কি আজ পর্যন্ত ইউজিসি গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড বা ইউজিসি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন? বাংলাদেশে উনার মতো বিজ্ঞানী দ্বিতীয় আরেকজন নেই। যদি না পেয়ে থাকেন তাহলে ইউজিসির জন্য এইটা একটা স্ক্যান্ডাল। আর যদি পেয়ে থাকেন এইটা কেন দেশের সকল মিডিয়াতে আসেনি? মিডিয়ায় প্রকাশিত হলে আমাদের নতুন প্রজন্ম জানতো এবং অনুপ্রাণিত হতো যে এই দেশেও এই মানের বিজ্ঞানী আছে। কিছুদিন আগে উনার একটি আর্টিকেল বিশ্বখ্যাত সাইন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল। সেটি ওই ইস্যুর প্রচ্ছদে জায়গা পেয়েছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশের ছবি বিশ্বখ্যাত জার্নালের প্রচ্ছদে। এটি কী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ফলাও করে প্রকাশ করেছিল?

আমি ক্ষুদ্র একজন গবেষক। আমার এখন পর্যন্ত ৪০ এর অধিক গবেষনাপত্র বিশ্বমানের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে পদার্থবিজ্ঞানের বনেদি প্রকাশক আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ফিজিক্যাল রিভিউ ই-তে ১৮টি আর্টিকেল প্রকাশ করেছি। এর মধ্যে ১১টিই বাংলাদেশে বসে মাস্টার্সের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে করেছি। একটি বই টেলর ফ্রান্সিস প্রকাশক থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তবুও কোনোদিন কোনো অ্যাওয়ার্ড এর জন্য দরখাস্ত করবো এটা আজ পর্যন্ত কল্পনাতেও আসেনি এবং ভবিষ্যতে কোনোদিন আসবেও না। যদি কোনোদিন আসে বুঝতে হবে আমার আত্মসম্মানবোধ লোপ পেয়েছে। সে আমি যত বড় গবেষকই হয়ে যাই না কেন। অ্যাওয়ার্ডের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করাই প্রমাণ করে আমরা শিক্ষা ও গবেষণায় কোথায় আছি।

লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৩/০৯/২০২৩     

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়