শিক্ষাবার্তা ডেস্কঃ সফিউদ্দিন সরকার একাডেমি অ্যান্ড কলেজ। শিক্ষক ও পরিচালনা পর্ষদের অনিয়ম, লুটপাট আর দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে টঙ্গীর সর্ববৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। প্রায় ৬ হাজার শিক্ষার্থীর এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছে শিক্ষার জন্য আসা ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকরা। নামকরা প্রতিষ্ঠানটিতে অভিভাবকদের পকেট লুটের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ফেল বাণিজ্য’। বার্ষিক পরীক্ষাগুলোতে অস্বাভাবিকভাবে ৮-১১ বিষয়ে অকৃতকার্য হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। আর ওপরের শ্রেণিতে উত্তীর্ণ কিংবা ভর্তির জন্য তাদের কাছ থেকে দাবি করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের অভিযোগ, এ অপকর্মে নেতৃত্ব দিচ্ছেন কলেজের অধ্যক্ষ মো. মনিরুজ্জামান ও সহকারী অধ্যক্ষ কাসেমসহ প্রতিষ্ঠান প্রধানরা । আর এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিবাজ শিক্ষকরা কাজ করছেন পাহারাদারের ভূমিকায়।
এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক মো. মিজান বলেন, ৯, ১০, ১১ বিষয় ফেল কোনো কথা না। ‘আমাদের ক্রায়টেরিয়া’র মধ্যে পড়লে আমরা তাদেরকে ওপরের শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার জন্য বিশেষ বিবেচনায় অনুমতি দিই।
অভিভাবকরা জানায়, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার প্রধান উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে নতুন ছাত্র ভর্তি বাণিজ্য আর ওপরের শ্রেণিতে ভর্তি করানো । ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় নতুন ছাত্র ভর্তি ও ফেল করা ছাত্র ওপরের শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা হচ্ছে। ভর্তি বাণিজ্যের সঙ্গে স্কুলের পিয়ন, অফিস সহকারী ও শিক্ষক থেকে শুরু করে তাদের আত্মীয়রা সবাই জড়িত। একটি ভর্তি করতে পারলেই হাজার হাজার টাকা।
বাণিজ্য এখানেই শেষ নয়। স্কুলের ড্রেসের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিশাল কমিশন। শুধু এই কমিশন থেকেই প্রতি বছর অভিভাবকদের পকেট থেকে লুট হচ্ছে প্রায় কোটি টাকা। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জানায়, ‘নবম শ্রেণির একজন ছাত্রকে এক সেট ড্রেসের জন্য দিতে হচ্ছে ৩ হাজার ৪০০ টাকা, যা ভর্তি ফির সঙ্গে নিয়ে নেওয়া হয়। এ ছাড়া খাতা-কলম-কাগজ এবং ডায়েরি ইত্যাদি বিক্রির কনট্রাক্ট দেওয়া হয়েছে ‘বই মেলা’ নামের এক লাইব্রেরিকে। এই খাতা-কলম-কাগজ এবং ডায়েরি বিক্রির টাকা থেকেও রয়েছে বিশাল কমিশন বাণিজ্য। এ ছাড়াও রয়েছে টিউশন ও অন্যান্য ফি, গ্রন্থ পাঠ্যভুক্তির বিনিময়ে প্রকাশকদের কাছ থেকে কমিশন আদায়। হালে এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে প্রতিষ্ঠানের জন্য বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কাজের নামে অর্থ লুটের প্রবণতা।
অবিশ^াস্য হারে ‘সিটিং অ্যালাউন্স’ গ্রহণও শিক্ষক-কর্মচারীদের আয়ের আরেকটি বড় খাত। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের গচ্ছিত অর্থ ব্যাংকে এফডিআর করে বাণিজ্যের অভিযোগ আছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। প্রায় সারা দিনই বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের আনাগোনা থাকে অধ্যক্ষের কক্ষে।
এ ছাড়া অসাধু শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে কোচিং-প্রাইভেটে বাধ্য করে আসছেন বহুদিন ধরে। স্কুলের ১০০ গজের মধ্যে গড়ে উঠেছে ৫০০-এর অধিক কোচিং সেন্টার। স্কুলের শিক্ষকরা নিজেরাই এগুলো পরিচালনা করছেন। কোচিংবাজদের ‘সুরক্ষা’ দেওয়ার বিনিময়ে মোটা কমিশন নেন পরিচালনা কমিটি, অধ্যক্ষ ও সহ-অধ্যক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৭ সালে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার ২ বছরের মধ্যেই গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৫৩ নং ওয়ার্ডে ২ কোটি টাকা মূল্যের বাড়ির মালিক বনে গেছেন মো. মনিরুজ্জামান। স্কুলের সহ-অধ্যক্ষ মো. কাশেমেরও রয়েছে আউচপাড়ায় ডিসেন্ট টাওয়ারে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক বলেন, আমার মেয়ে ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী। সে এবার টেস্টে ৫ বিষয়ে ফেল করে। পরে আমি কাশেম স্যারের বাসায় গিয়ে একা তার সঙ্গে দেখা করে ২০ হাজার টাকা দিলে আমার মেয়েকে টেস্টে অ্যালাও করে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দেন।
স্কুলের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে এই অভিভাবক বলেন, এই স্কুলে যতদিন মেয়েকে পড়িয়েছি ততদিন নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছি। এক সেট ড্রেস বাইরে থেকে বানাতে খরচ হয় ২ হাজার টাকা। আর এখানে দিতে হয়েছে ৪ হাজার টাকা। স্কুলের শিক্ষক দিয়ে প্রাইভেট না পড়ানোর কারণে আমার মেয়েকে বহুবার ফেল করানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ডিআইএ পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ মো. আজমতগীর বলেন, সরকারি-বেসরকারি উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানই আমরা পরিদর্শন ও তদন্ত করে থাকি। আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, শিক্ষকরা শিক্ষা প্রদানের চেয়ে অর্থ উপার্জনে বেশি আগ্রহী। এক সময় সেবার মানসিকতা নিয়ে শিক্ষানুরাগীরা কমিটিতে এলেও এখন চিত্র পালটে গেছে। তিনি বলেন, একা সভাপতির পক্ষে যেমন অনিয়ম করা সম্ভব নয়, আবার অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষকও একা পারবেন না। টঙ্গীর সফিউদ্দিন সরকার একাডেমি অ্যান্ড কলেজে অনিময়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা বিষটি তদন্ত করব।
৯-১১ বিষয়ে ফেল করা শিক্ষার্থীরা কীভাবে ওপরের ক্লাসে উত্তীর্ণ হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে স্কুলের সহ-অধ্যক্ষ মো. কাশেম বলেন, রেজাল্টের আগে গভর্নিং বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় যে সিদ্ধান্ত হয় সে অনুসারে ওপরের ক্লাসে উর্ত্তীণ করা হয়।
সব অভিযোগ অস্বীকার করে স্কুলের অধ্যক্ষ মো. মনিরুজামান বলেন, স্কুল নিময় অনুযায়ী চলছে। আমরা নিয়মের বাইরে কোনো কাজ করি না।
এ ব্যাপারে গাজীপুর জেলা শিক্ষা অফিসার রেবেকা সুলতানা জানান, ‘২-৩ বিষয়ে ফেল করলে ওপরের ক্লাসে ভর্তি হতে পারে। কিন্তু ৯ বিষয় ফেল তো কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য না।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০১/৩১/২৩