অতিমারিতে পাবলিক পরীক্ষাঃ সমস্যা ও সম্ভাবনা
শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত নানা পরিকল্পনা করা হলেও ২০২০ সালে সেগুলো বাস্তবায়ন করা যায়নি। পরীক্ষা ছাড়াই শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শ্রেণিতে প্রমোশন দিতে হয়েছে। প্রমোশন দেওয়া হলেও আগের বছরের ধারাবাহিকতা রক্ষায় পরবর্তী শ্রেণিতে রিকভারি প্ল্যান ছিল কিন্তু তারও বাস্তবায়ন হয়নি। ২০২০ সালে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি, তবে রেমেডিয়াল প্ল্যান ছিল। ২০২০ শিক্ষাবর্ষে যে বিষয়গুলো বাদ পড়েছিল সেগুলো এবার পাঠদানের সঙ্গে যুক্ত করার কথা। সেরকম পরিকল্পনাও করা হয়েছিল কিন্তু এবারও যেহেতু বিদ্যালয় খোলা যায়নি তাই পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই একটা লন্ডভন্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। হাতেগোনা কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম কিছুটা চালিয়ে গেলেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থী কার্যত শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে। করোনার সংক্রমণ যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে এবার আদৌ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে কি না, সেই সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। চলতি বছরে স্কুল কার্যক্রম না চললে আর আগামী বছরের জানুয়ারিতে স্কুল খোলা গেলে শিক্ষার্থীদের বাড়তি চাপ সইতে হবে। প্রথম থেকে দশম শ্রেণির কারিকুলাম একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সাজানো। কোন বয়সে একজন শিক্ষার্থীর কতটুকু আয়ত্ত করার ক্ষমতা আছে, সেই আলোকেই শ্রেণিগুলোর কারিকুলাম তৈরি করা হয়। একটি বর্ষের পাঠ্যবই না পড়ে ওপরের শ্রেণির পাঠ্যবই পড়লে শিক্ষার্থীও পড়াশোনার ধারাবাহিকতাও হারিয়ে যায়। অনেক কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে ২০২২ শিক্ষাবর্ষে পাঠদান প্রক্রিয়া চালু করার প্রস্তুতিও এবার নিতে হবে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, ২০২২-এর জানুয়ারিতে স্কুল খোলা হলে একজন শিক্ষার্থী ২০২০, ২০২১ ও ২০২২—এই তিন বছরের কারিকুলামের চাপে পড়তে যাচ্ছে। সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হামিদা আলী বলেন, ‘ভর্তি পরীক্ষার সময় আমরা যে পরীক্ষা নিই তখন কে কোন বিষয়ে ভালো করেছে তার ভিত্তিতেই পরবর্তী বিষয় নিরূপণ করা হয়। কে বিজ্ঞান পড়বে, কে কমার্স পড়বে, কে মানবিক বিষয়ে পড়বে সেটা নির্ধারণ করা যায়। এতে খুব একটা সমস্যা হয় না। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে মেধা যাচাই করে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া উচিত। তাতে দুর্বল ও সবল শিক্ষার্থী বোঝা যাবে। দুর্বলদের ভালো করার জন্য শিক্ষকগণ প্রস্তুত করবেন, মেধাবীদের সুযোগ করে দেবেন, যাতে তাদের মেধা ভবিষ্যতে কাজে লাগাতে পারে। ’ হামিদা আলীর দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতাপ্রসূত কথাগুলো আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক।
করোনার থাবায় শিক্ষা কার্যক্রম বিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত রাখার জন্য অ্যাসাইনমেন্ট একটি কার্যকর পদক্ষেপ, তাতে সন্দেহ নাই। অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা সরাসরি সম্পৃক্ত হয়। তাই এর মাধ্যমে শিখন শেখানো কার্যক্রম অনেক ফলপ্রসূ হয়। অ্যাসাইনমেন্ট করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেট থেকেও তথ্য নেয়। যা তাদের জ্ঞানের গভীরতা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু এটি পাবলিক পরীক্ষার বিকল্প হতে পারে না। আবার এটিও সত্য যে, অ্যাসাইনমেন্ট বিষয়টি কিন্তু মূলত বয়স্ক শিক্ষার্থী অর্থাৎ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বিষয়। শিক্ষার্থীদের ম্যাচিউরিটি ও সৃজনশীলতা, অভ্যাস ও কালচারের সঙ্গে বিষয়টি জড়িত। তবে, বিদ্যালয়ে সেটিকে নিয়ে আসা হয়েছে করোনার অতিমারির কারণে। সেটি নেগেটিভ সমালোচনার বিষয় নয়, তবে তা দিয়ে পাবলিক পরীক্ষার বিকল্প হিসেবে মূল্যায়ন করার বিপক্ষে শিক্ষাবিদদের মত। এটিও কিন্তু ঠিক যে, সব শিক্ষার্থীই কিন্তু পাঠ্যবই ও নেটের সাহায্যে অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করেনি এবং করে না। অনেকেই নোট, গৃহশিক্ষক, বড় ভাই বা বোন এমনকি কোচিং সেন্টারের ওপরও নির্ভর করে অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করে। অ্যাসাইনমেন্ট স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমের বিকল্প নয়, অন্তত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে। তাই সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের ভিত্তিতে প্রয়োজনে সময় কমিয়ে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। এজন্য প্রয়োজন হলে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করে নম্বর ও সিলেবাস কমিয়ে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। আর অ্যাসাইনমেন্টের জন্য ১০ নম্বর রাখার কথা বলেছেন অনেক শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক। তারা ২৫ কিংবা ৫০ নম্বর রাখার পক্ষে নয়। তাই মৌলিক বিষয়গুলো এবং একটি বিষয় বোঝার জন্য যেসব জায়গায় ধারণা থাকা দরকার, সেই বিষয়গুলোর ওপর জোর দিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও ইন-পারসন পরীক্ষা নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন অনেকেই। বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে সাধারণত ৫ থেকে ১০ শতাংশ নম্বর থাকে অ্যাসাইনমেন্টে। সেগুলোও আবার সারা বছর ক্লাসের ভিত্তিতে শিক্ষকগণ সেই নম্বর দিয়ে থাকেন। আর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ক্ষেত্রে যা হচ্ছে, তা হলো শিক্ষার্থীরা ১৬ মাস যাবত্ ক্লাস, শ্রেণি কার্যক্রম, শিক্ষকের সাহচর্য থেকে বঞ্চিত, ক্লাসের ঘণ্টার আওয়াজ তারা শুনছে না ১৬ মাস যাবৎ। কিছু কিছু বিদ্যালয় মাউসি থেকে প্রদত্ত অ্যাসাইনমেন্টের নমুনা অনুযায়ী নিজেরা বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন তৈরি করে। নতুন অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে ব্যস্ত রেখেছে। এ ধরনের বিদ্যালয়ের সংখ্যা হাতেগোনা কয়েকটি। তারা এগুলো করেছেন যাতে শিক্ষার্থীরা বাইরের কোনো অ্যাসাইনমেন্ট নিজেদের খাতায় তুলে না দেয়। এটিও চমৎকার পদক্ষেপ।
শিক্ষাবার্তা/ আমিন