জগার খিচুড়ি ও আমাদের খিচুড়ি যাত্রা
কাকন রেজা।।
জগাখিচুড়ির ইতিহাসটা জানা আছে তো। ওই যে পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে ভক্তরা চাল, ডাল, আলু, কলা যা দিতেন সব মিলে যা হতো তাই হলো জগাখিচুড়ি। আমাদের অবস্থাটাও বোধহয় জগন্নাথ দেবের মন্দিরের মতন। যে যা ইচ্ছে করতে চাচ্ছেন। কেউ খিচুড়ি রান্না শিখতে বিদেশ যেতে চাচ্ছেন, কেউ বাড়ি তৈরি দেখতে, কেউ বা পুকুর কাটা শিখতে। অদ্ভুত সব আবদার আর কারবার।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক হাজার কর্মকর্তা খিচুড়ি রান্না শিখতে বিদেশ যেতে চেয়েছেন। এটা বুধবারের গণমাধ্যমের খবর। দিনভর এটা নিয়ে কথা হচ্ছিল সামাজিকমাধ্যমে। এই খবরটা ঢেকে দিয়েছিল আগের দিনের আরেকটি খবর। খবরের শিরোনাম ছিলো, ‘ভবন দেখতে বিদেশ যাবেন ৩০ কর্মকর্তা’। গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তপরের প্রস্তাব এটি। খবরে বলা হয়েছে, এই প্রস্তাবটি যে কোনো সময় অনুমোদনের জন্য তোলা হবে। চিন্তা করতে পারেন, ভবন দেখতে বিদেশ যাওয়া! আরে ভবন দেখতেই যদি বিদেশ যেতে হয়, তাহলে তো আমাদের উন্নয়নের গল্পগুলো মিথ্যে হয়ে যায়। এমন একটা খবরের আলোচনা শেষ হতে না হতেই জায়গা দখল করে নিল ‘খিচুড়ি’। অবস্থাটা দাঁড়ালো জগাখিচুড়িতে। মৌমাছি পালন শিখতে বিদেশ, আলু চাষ শিখতে বিদেশ, ক্যামেরা দেখতে বিদেশ। এমন সব বিদেশ যাবার খায়েশ মিলিয়ে রীতিমত জগন্নাথ দেবের খিচুড়ি।
আচ্ছা এতো সমালোচনার পর বারবার এই বিদেশযাত্রার মতন এমন সব ফানি কারবার কেন হচ্ছে, এ ব্যাপারে কি কারো মনে কোনো প্রশ্ন জাগে না! আমাদের প্রশাসনের লোকজন কি এতই উজবুক! তারা বারবার এমন ফানি কাণ্ড করবেন! আমার মনে হয় না। আমাদের প্রশাসনে বহু যোগ্য লোক রয়েছেন। বারবার একই কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি তাদের দ্বারা সম্ভব নয়। তবে... প্রশ্নটা এই ‘তবে’তেই।
যারা মারিয়ো পুজো’র গডফাদার পড়েছেন। যারা মাফিয়াচক্র সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন। তারা সবাই জানেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গণমাধ্যম ও মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য মাফিয়ারা প্রথমে একটি ছোটো অপরাধ ঘটায়। সেই অপরাধ নিয়ে যখন সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠে, সেই ব্যস্ততার আড়ালে মূল ঘটনাটা, মূল অপরাধটা ঘটায় মাফিয়া চক্র।
আমার এক পরিচিতজনের কাছ থেকে শোনা আরেকটি গল্প বলি। বিমান বন্দরে সোনা চোরাচালানের গল্প। যখন কোনো বড় সোনার চোরাচালানের প্ল্যান থাকে তখন ছোটখাটো একটি চালান ইচ্ছা করেই ধরিয়ে দেয়া হয়। বিমান বন্দরের লোকজন সেই ছোটখাটো চালান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আসল কাজটা সারে চোরাচালানীরা।
যাক গে, আমাদের ইস্যুর পর ইস্যু। কাণ্ড আর কাণ্ড। বালিশ কাণ্ড থেকে মালিশ কাণ্ড। প্রদীপ ইস্যু থেকে জিনিয়া ইস্যু। এই যে নতুন করে সামনে ইলিশ আর পেঁয়াজ ইস্যু। একটা এসে আরেকটা ঢেকে দিচ্ছে। মারিয়ো পুজো’র গল্পের মতন এমনসব টোটকা ইস্যুর ডামাডোলে হয়তো বড় কোনো ইস্যু দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে, হজম হয়ে যাচ্ছে।
আশা করি যারা মুখটা খুলতে চেয়েছিলেন এই বলতে যে, খিচুড়ি বিষয়ক ইস্যুতে আমি কেনো মারিয়ো পুজো আর বিমান বন্দরের গল্প নিয়ে এলাম। তাদের অনুচ্চারিত সে প্রশ্নের উত্তরটা নিশ্চয় আর দিতে হবে না। ডেভিড কপারফিল্ড যে জাদুতে গাড়ি উধাও করে দেন। সেই উধাও জাদুর প্রধান উপকরণ হলো একটা বড় পর্দা। গাড়িটা পর্দা দিয়ে ঢাকার পরই উধাও হয়ে যায়। সব জাদুশিল্পীরই পর্দা একটা মহা অবলম্বন। তাদের ট্রিকস পর্দাতেই থাকে। আমরাও জাদুর জগতেই বাস করছি। জাদু বাস্তবতায়। এখানে ঢেকে দেয়াটাই হলো মূল ট্রিক, কৌশল।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।