এইচএসসি পরীক্ষা :লাভ-ক্ষতির হিসাব
মোহম্মদ শাহিন।।
সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের কারণে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা বাতিল করে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের গড় মূল্যায়ন করে আগামী ডিসেম্বরে ফলাফল প্রদানের ঘোষণা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষার্থীদের জীবনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিকল্প ছিল না বলে উল্লেখ করেন শিক্ষামন্ত্রী।
আমাদের জীবনে যতগুলো পাবলিক পরীক্ষা রয়েছে, তার মধ্যে এইচএসসি পরীক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত্ ও উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ও ভিত এখানেই গড়ে ওঠে। এইচএসসি ও সমমানের এই পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় মূলত শিক্ষার্থীর অর্জনটা কোন অবস্থায় আছে সেটি যাচাইয়ের জন্য। দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কিংবা ভবিষ্যত্ চাকরি বাজারে এইচএসসির রেজাল্ট কতটা প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে তা সহজেই অনুমেয়। করোনা ভাইরাসের কারণে ইতিমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা বাতিল করা হয় এবং এখনো এটি নিয়ন্ত্রণে না আসার দরুন এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাও বাতিল ঘোষণা করল সরকার। পরীক্ষা বাতিলের এই সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। কেউ এটিকে দেখছে ইতিবাচক দিক হিসেবে, আবার কেউ দেখছে নেতিবাচক হিসেবে।
প্রত্যকে জিনিসেরই ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক রয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষা বাতিলের ইতিবাচকতা হলো—এই সিদ্ধান্তের ফলে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের একটা উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা ও অনিশ্চয়তার অবসান ঘটেছে। কেননা, তারা একটা দোদুল্যমান অবস্থায় ছিল যে পরীক্ষা আদৌ হবে কী হবে না।
লাভ-ক্ষতির হিসাব যতটুকুই হোক না কেন এ সিদ্ধান্তের ফলে আগামী দিনে যে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হবে এবং সেগুলো মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ও তরিত্ব সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রথমত, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হবে। উচ্চমাধ্যমিক ফলাফলের ওপর ভিত্তি করেই বুয়েটে কে কে পরীক্ষা দিতে পারবে, তা নির্ধারিত হয়। সেক্ষেত্রে এবার পরীক্ষার্থীর সংখ্যা হারহামেশাই বাড়বে। আর বেশিসংখ্যক পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষার সুযোগ ও মূল্যায়ন—দুটি ক্ষেত্রেই বুয়েট কর্তৃপক্ষকে পড়তে হবে নতুন জটিলতায়। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষায় এইচএসসি ফলাফলের ওপর নির্ধারিত নম্বর থাকে। এবার তাহলে নম্বর বণ্টন নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষার্থী যেমন বিপাকে পড়বে তেমনি বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্নও উঠতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিভাগ পরিবর্তন করে যারা ভালো ফলাফলের আশায় অন্য বিভাগে ভর্তি হয়েছে, তাদের এমন অনেক বিষয় ছিল যা এসএসসিতে ছিল না, সেক্ষেত্রে তাদের জন্য স্বচ্ছ নীতিমালার মাধ্যমে মূল্যায়ন কতটা সাফল্যমণ্ডিত করা যায়, তা সুস্পষ্ট করতে হবে। তৃতীয়ত, যেহেতু ইতিহাসে এই প্রথম শতভাগ পাশ করানো হবে, সেহেতু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বাড়বে ব্যাপক হারে। সেক্ষেত্রে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করে শিক্ষায় বৈষম্য ও এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণমান ধরে রাখতে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। চতুর্থত, চাকরি বাজারে ২০২০ ব্যাচের সঠিক মূল্যায়ন হবে তার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। পঞ্চমত, বিদেশে উচ্চশিক্ষায় গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীরা যেন হয়রানির শিকার না হয়, সেদিকেও সুদৃষ্টি দিতে হবে এবং সর্বশেষ যদি সম্ভব হয়, শিক্ষার্থীদের নিকট কেন্দ্র ফিসহ ফর্ম ফিলাপের সময় নেওয়া টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হোক।
শিক্ষার্থীদের যথাযথ মূল্যায়নে জেএসসি ও এসএসসির সঙ্গে কলেজ পর্যায়ের বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল পর্যবেক্ষণে এইচএসসির ফলাফল মূল্যায়ন করা যায় কি না, সে বিষয়টি বিবেচনা করা হোক। অন্তত এবারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উচিত হবে স্নাতক পর্যায়ের ভর্তি পরীক্ষায় এসএসসি ও এইচএসসির জিপিএ সমন্বয়ের নম্বর তুলে দেওয়া এবং একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় বিষয়ভিত্তিক যে দু-চারটি প্রশ্ন থাকে তার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া। এতে করে পরিশ্রমী ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে আসবে বলে আশা করা যায়। সুতরাং পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, সেগুলো অতিক্রম করতে পারলে তা হবে যুগান্তকারী।
লেখক :শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়